আলী হুসাইন আকবর আলী, চেয়ারম্যান, বিএসআরএম গ্রুপ

Posted on December 7, 2016

গ্যাসের দাম বাড়ানো নিয়ে গণশুনানি চলছে। গ্যাসের দাম বাড়ালে লৌহ ও ইস্পাত খাতে কী প্রভাব পড়বে এবং এই খাতের বর্তমান সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ইস্পাত খাতের অন্যতম শিল্পোদ্যোক্তা বিএসআরএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আলী হুসাইন আকবর আলী।

No image

 

প্রশ্ন: গ্যাসের দাম বাড়ানো নিয়ে শুনানি হচ্ছে। গ্যাসের দাম বাড়ালে লৌহ ও ইস্পাতশিল্পে কী প্রভাব পড়বে?
আলী হুসাইন আকবর আলী: লৌহ ও ইস্পাতশিল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং লোহা প্রক্রিয়াজাত করতে বয়লার চালানোর জন্য গ্যাসের ব্যবহার হয়। গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে টেক্সটাইল খাতের পর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে লৌহ ও ইস্পাতশিল্প। কারণ উৎপাদন খরচ বাড়বে। বর্তমান প্রস্তাবনা অনুযায়ী গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে ইস্পাত খাতে রডসহ বিভিন্ন পণ্যের টনপ্রতি উৎপাদন খরচ ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা বাড়বে।
সরকার অনেকগুলো মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতেও অনেক প্রকল্প আছে। পণ্যের দাম বাড়লে সরকারি প্রকল্পেও ব্যয় বাড়বে; বরং এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আনার পর গ্যাসের দাম সমন্বয় করা যৌক্তিক হবে। সরকারের এখনই ঘোষণা দেওয়া উচিত, এলএনজি আনার পর গ্যাসের দাম বাড়ানো হবে। তাহলে সবাই প্রস্তুতি নিতে পারবে। এলএনজি আমদানি করলে তখন দাম একটু বেশি পড়বে। এলএনজির সঙ্গে গ্যাসের মূল্য গড় করতে হবে। তখন দাম বাড়ালে কেউ আপত্তি দেবে না। এখন গ্যাসের দাম বাড়ানোর কোনো যুক্তি নেই।

প্রশ্ন: লৌহ ও ইস্পাতশিল্পে কী ধরনের সরকারি নীতিসহায়তা চাচ্ছেন?
আলীহুসাইন আকবরআলী: প্রথমেই বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত কয়েকটি জ¦ালানি পণ্যÑগ্যাস, ফার্নেস অয়েল ও ‘এলডিও’র দাম সমান হওয়া উচিত। জ¦ালানির দাম সমান না হলে যার কাছে গ্যাস আছে, সে-ই ভালো অবস্থায় থাকবে। যার কাছে গ্যাস নেই, তাকে ফার্নেস অয়েলসহ অন্য জ¦ালানি ব্যবহার করতে হয়। ফলে খরচ পড়বে বেশি। সুতরাং মূল্য নীতিগতভাবে কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে শিল্প খাতে বৈষম্য থাকবে না। কারও কিছু বলার থাকবে না।
আরেকটি বিষয় আছে। গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্দেশ্য হলো বিদ্যুতের দর বাড়ানো। বর্তমান হারে ফার্নেস অয়েল আমদানি করা হলে প্রতি কিলোওয়াটে পাঁচ টাকা খরচ পড়বে। সরকারি রেট চার টাকা। সরকার নির্ধারিত কিছু বেসরকারি খাতে আমদানির অনুমতি দিলেও শিল্প খাতে আমদানির অনুমতি দিচ্ছে না। বেসরকারি শিল্প খাতে ফার্নেস অয়েল আমদানির সুযোগ দিলে ক্যাপটিভ পাওয়ার গড়ে তুলতে পারবেন শিল্পোদ্যোক্তারা। আট মাসের মধ্যে বিদ্যুৎ প্রকল্প করতে পারব আমরা। জায়গাও কম লাগবে। তাহলে বিদ্যুৎ সমস্যারও সমাধান হয়ে যাবে।

No image

 

প্রশ্ন: লৌহ ও ইস্পাত পণ্যের আমদানি হওয়া ভারী কাঁচামাল পরিবহনে এ খাতের উদ্যোক্তারা বন্দর দিয়ে ভালো সেবা পাচ্ছেন না বলে অনেক দিন ধরে অভিযোগ করছেন। সেবার মান এখন কেমন?
আলী হুসাইন আকবর আলী: ভারী কাঁচামাল পরিবহনে সামনে একটা দুর্যোগ আসছে। সম্প্রতি কাঁচামালবাহী কোনো কোনো জাহাজ এক মাসও জেটিতে ভেড়ার জন্য বন্দরের বাইরে অপেক্ষা করতে হয়েছে। অনেক জাহাজ অপেক্ষমাণ থাকায় বাড়তি ক্ষতিপূরণ গুনতে হয়েছে উদ্যোক্তাদের। এতে খরচ বাড়ছে। অর্থনীতিতেও প্রভাব পড়ছে। বন্দর সুবিধা বাড়ানোর জন্য ‘বে টার্মিনাল’ নামে নতুন একটি প্রকল্প চালু করার কথা ছিল চট্টগ্রাম বন্দরের। বে টার্মিনালে শিল্পের কাঁচামালবাহী জাহাজ থেকে পণ্য খালাসের সুযোগ পাওয়া যেত। কিন্তু এখনো তেমন অগ্রগতি হয়নি। তিন বছর আগে আমরা যখন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করার পরিকল্পনা শুরু করি, তখন বন্দর থেকে আমাদের লিখিত দেয় যে তিন বছরের মধ্যে বে টার্মিনাল বানানো হবে। আমরা এই টার্মিনাল দিয়ে কয়লা খালাস করব। আমরাও কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প শুরু করি। বিদ্যুৎ প্রকল্পের পুরো কাজ যদি এখন শেষ হতো তাহলে আমরা বিপদে পড়ে যেতাম।
সরকারের এখন উচিত হবে প্রকল্পটি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে দেওয়া। কারণ সরকারিভাবে এই প্রকল্প করলে অনেক সময় চলে যাবে। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে প্রকল্পটি শেষ করে পণ্য ওঠানো-নামানোর দর সরকার ঠিক করে দিতে পারে। এটি আকর্ষণীয় প্রকল্প। দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং উৎপাদনমুখী খাতের বিকাশের জন্য বে টার্মিনাল নির্মাণের প্রকল্পটি সবচেয়ে এবং সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

প্রশ্ন: শিল্প খাতে এখন সমস্যা কী?
আলী হুসাইন আকবর আলী: জমির সংকটই এখন বেশি। কোনো শিল্পকারখানা করার জন্য এখন উপযুক্ত জমি পাওয়াটা দুষ্কর। তবে সরকার অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ার যে উদ্যোগ নিয়েছে, সেটি ভালো। উদ্যোক্তারা অর্থনৈতিক জোনে শিল্পকারখানা গড়ার সুযোগ পাবেন। অবশ্য অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ শেষ হতেও কয়েক বছর লেগে যাবে। আবার প্রক্রিয়াগত জটিলতাগুলোও সহজ করা উচিত। যেমন, তিন বছর আগে দেশে প্রথম মার্চেন্ট পাওয়ার প্রকল্প করার প্রক্রিয়া শুরু করেছিলাম আমরা। তবে এখনো চূড়ান্ত হয়নি। ভূমি ও রেলওয়ে বিভাগ এখনো চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়নি। এই কাজগুলো সহজ করা হলে উদ্যোক্তারা সুফল পাবে।প্রশ্ন: জঙ্গি হামলার ঘটনার পর শিল্প খাতে কোনো প্রভাব পড়েছে কী?
আলী হুসাইন আকবর আলী: গুলশানের ঘটনার পর একটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল। অনিশ্চয়তা তৈরি হলে ব্যবসার পরিবেশ থাকে না। অবশ্য ওই ঘটনার পর সরকার খুব ভালো পদক্ষেপ নিয়েছে। আশা করছি, অনিশ্চয়তা কেটে যাবে।

প্রশ্ন: লৌহ ও ইস্পাতশিল্পের প্রস্তুত পণ্যের বাজার এখন কেমন?
আলীহুসাইন আকবরআলী: বর্তমানে ইস্পাত পণ্যের বাজারে কিছুটা ধীরগতি আছে। তবে সামনে এই বাজারে সম্ভাবনা অনেক। এই সম্ভাবনাকে মাথায় রেখে বিএসআরএম নতুন নতুন পণ্য বাজারে আনছে। একটা পণ্য নিয়ে থাকতে চাই না। সমুদ্র উপকূলবর্তী প্রকল্পের জন্যও নতুন পণ্য আনছি।
বেসরকারি খাত ঘুরে দাঁড়ালে ইস্পাত খাত আরও চাঙা হবে। যেমন, আবাসন খাত এখন ভালো নেই। আবাসন খাতে ফ্ল্যাট বা প্লটের মূল্য কমানো হলে এই খাত ঘুরে দাঁড়াবে। দীর্ঘ মেয়াদে আবাসন খাতে নীতিসহায়তা দেওয়া হলে অনেকগুলো খাত চাঙা হবে। সরকারেরও লাভ হবে। কারণ কর্মসংস্থান বাড়বে। স্যানিটারি, সিমেন্ট, লৌহ ও ইস্পাতশিল্পসহ অনেক খাতই ঘুরে দাঁড়াবে। প্রাণ পাবে। সূত্র: প্রথম আলো।