১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরে পাকিস্তানকে পরাজিত করে বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে নতুন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ৪৫ বছর বয়স্ক এই দেশ বিশ্ব দরবারে কতটা পরিচিত? তার অর্জন কতটুকু? ব্যর্থতাই বা কতটুকু? এসব প্রশ্নগুলো বছরের অন্যান্য যে কোন দিনের চেয়ে ১৬ ডিসেম্বরে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে। আসাটাই স্বাভাবিক। কারণ, সেই একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর থেকে এ দেশের যাত্রা শুরু হয়। তখন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত এ দেশের বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তিত হয়েছে। অর্জিত হয়েছে অনেক কিছুই, আবার ব্যর্থতার গ্লানিও আছে বেশ।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর প্রথম দিকে তার দারিদ্রতার হার চেয়ে ছিল অনেক বেশি। প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ ছিল অতিদরিদ্র। বাংলাদেশ ছিল একেবারেই অনুদান নির্ভর। অনুদান পাওয়ার পরও এদেশকে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক সমস্যায় ভুগতে হয়। এ জন্য বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ির তকমাটিও পেতে হয়। সেখানে আজ অতি দারিদ্রের সংখ্যা ২২ থেকে ২৫ শতাংশ। অর্থাৎ, অতি দারিদ্রের হার এখন চলে গেছে বিশের ঘরে। দেশের স্বাস্থ্য সমস্যাও ছিল বেশ। পোলিও থেকে শুরু করে অনেক ধরনের রোগে মানুষকে ভুগতে হতো। সেখানে আজ বাংলাদেশ পোলিওমুক্ত। স্বাধীন হবার পর প্রথম দিকে, এ দেশের খাদ্যেরও অভাব ছিল ঢেড়। এখন বাংলাদেশ তার যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্যের যোগান দিতে পারছে। যদিও দেশের খাদ্যের অভাব সম্পূর্ণভাবে দূর করতে পারেনি। কিন্তু পূর্বের তুলনায় এ খাতে বাংলাদেশের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। আর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি বিশ্বেও আলোচিত হয়েছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার এখন ৭ শতাংশের ঘরে। নারী শিক্ষা ও ক্ষমতায়ন, শিশুর মৃত্যুর হার, কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির মত ব্যাপারগুলোতে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করেছে। তবে যে কারণে বাংলাদেশ বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পরিচিত লাভ করেছে তা হচ্ছে এ দেশের পোশাক শিল্প। এ দেশের তৈরি পোশাক আজ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে রপ্তানি হচ্ছে। এ কারণে উন্নত বিশ্বে আজ বাংলাদেশ নামটি মোটামুটি পরিচিত বলা যায়। এ ছাড়াও জনশক্তি রপ্তানিতেও সাফল্য অর্জন করেছে। যদিও বিগত কয়েক বছর যাবত এ খাতটিতে মন্দাভাব যাচ্ছে। কিন্তু এরপরও জনশক্তি রপ্তানি থেকে এখনো বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক আয় করছে। বৈদেশিক সাহায্যের উপরে এক সময়ের সে নির্ভরশীলতা এখন অনেক কমেছে। এর উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নিজ খরচে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ। এক সময়কার তলাবিহীন ঝুড়ির তকমা পাওয়া এ দেশকে এখন দ্রুত অর্থনৈতিক বর্ধনশীল দেশগুলোর একটি বলা হচ্ছে।
তবে সাফল্য থাকলেও ব্যর্থতার পাল্লার ভার আছে বেশ। এদেশের প্রথম বড় সমস্যাটি হচ্ছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার চার দশকের মাথায় বেশ কয়েকবার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু এখনো এ দেশ একটি শক্ত রাজনৈতিক বা স্থিতিশীল শাষণ ব্যবস্থায় দাঁড়াতে করাতে পারেনি। আজও দেশের দুই বড় দলের মধ্যে ব্যাপক দূরত্ব রয়ে গেছে। রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনাও ঘটেছে প্রচুর। প্রাণ গেছে অনেক মানুষের। তবে এ বছরে যদিও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার ঘটনা তেমন বড় পরিসরে ঘটেনি; কিন্তু দুই বড় দলের মধ্যে পারস্পারিক যে সহিংস মনোভাব ছিল তা আজও বিদ্যমান রয়েছে। এ ছাড়াও এখনো প্রায় ৪ কোটি মানুষ রয়েছে দারিদ্রতার মধ্যে। তবে যে ঝুঁকিতে বাংলাদেশ রয়েছে তা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশ এখনো তেমন শক্তি অর্জন করতে পারেনি। এর দায়ভার শুধু বাংলাদেশের একার নয়, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোরও রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিতে উন্নত শক্তিশালী দেশগুলো আজও কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে যেতে পারেনি। ফলে বাংলাদেশও পাচ্ছে না অগ্রিম কোন ক্ষতিপূরণের অর্থ।
আরো একটি বিষয় সাম্প্রতিক সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে তা হচ্ছে জঙ্গিবাদ। এ বছরে ঢাকার গুলশানে ঘটে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার ঘটনা। হলি আর্টিজানের সেই ভয়াবহ ১ জুলাইয়ের রাতের ঘটনা আজও মানুষ ভুলতে পারেনি। তারপরে ঘটে সেই শোলাকিয়ার হামলা। এসব ঘটনার পর পর জঙ্গিবাদ সবাইকে আতঙ্কিত ও ভাবিয়ে তুলে। জঙ্গিবাদ নিয়ে নড়েচড়ে বসে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
বাংলাদেশের সামনে যেসব চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে সেসবের জন্য তার প্রস্তুতি নিয়ে সংশয় রয়েছে সবার। এর মধ্যে জনসংখ্যার বিষয়টি কিন্তু একেবারেই উপেক্ষিত। বিভিন্ন সমীক্ষা ও জরিপ বলছে, দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে নেই। বাড়তি জনসংখ্যার সাথে যদি সম্পদ ও অর্থনীতির বৃদ্ধিও সামঞ্জস্য না হয় তাহলে তা দেশের জন্য অনেক বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। বাংলাদেশ আয়তনে বড় নয়। কিন্তু জনসংখ্যা তার আয়তনের চেয়ে অনেক বেশি। বিশ্বে আয়তনে সবচেয়ে বড় রাশিয়ার চেয়ে এ দেশের জনসংখ্যা বেশি। এখন বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটির বেশি। সুতরাং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণও বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
স্বাধীনতার ৪৫ বছরে বাংলাদেশের প্রাপ্তি ও ব্যর্থতা কোনটি ছোট করে কিংবা উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। এখন দেশের সরকার থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণ যদি সাফল্যকে অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়ে সামনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ও বর্তমান ব্যর্থতার গ্লানি মুছে ফেলতে তৎপর হয়, তাহলে হয়তো সাফল্যের পাল্লা সামনে আরো ভারি হবে। দেশও এগিয়ে যাবে, সমাজ ব্যবস্থারও উন্নতি ঘটবে। হয়তবা তখন আমরা সেই স্বপ্নের সোনার বাংলাকে অনুভব করতে পারবো। বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশের সকল শহীদ ও জীবিত সকল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি রইল গভীর শ্রদ্ধা এবং দেশের সাধারণ জনগণের প্রতি রইল ভালবাসা ও শুভ কামনা।
© ২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | কর্পোরেট সংবাদ সম্পাদক - মোঃ মিজানুর রহমান । উপদেষ্টা সম্পাদক- জেসমিন আক্তার, এফসিএস ই-মেইলঃ corporatesangbad@gmail.com । ফোনঃ ০২২২-৩৩৫৪১২৫ । মোবাইলঃ ০১৭১১০৭৬৮১৫ অফিসঃ ৫৫/বি, নোয়াখালী টাওয়ার, ১১ তলা, সুইট ১১-এফ, পুরানা পল্টন, ঢাকা ১০০০ |
আজ মহান বিজয় দিবস: অর্জিত হয়েছেও যেমন, ব্যর্থতাও আছে তেমন https://corporatesangbad.com/467740/ |