বদরুল ইসলাম বাদল: শীত কালকে "বিয়ের মৌসুম" বলা হয়ে থাকে। বাঙালিদের সবচেয়ে আনন্দের অনুষ্ঠান বিয়ে। বছরের অন্যান্য সময়েও কমবেশি বিয়ে হয়। কিন্তু শীতকালীন সময়েই বিয়ের মহাউৎসবের আসর জমে বেশি। বিয়ে মানে বাঙালী জীবনের মহা হুলুস্থুল আয়োজন। জমিয়ে খাওয়া, কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া, প্রাণভরে খাওয়া, সাজ, নাচ, গান সহ কতকিছু। মৌসুমের এই সময়টাতে বিয়ে ক্লাবগুলোতে সিরিয়াল পাওয়া বেশ কঠিন। তাই আগেভাগে বুকিং দিয়ে রাখতে হয়। বর্তমান সময়ে শুধু বিত্তশালীরা নয়, মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের প্রতিটি ঘরের বিয়ে ক্লাবেই হয়ে থাকে। তাতে তিন-চার ঘন্টার জন্যে ঢালতে হয় একগাদা টাকা। আর খাবার-দাবার নিয়ে মহা আয়োজন। খাবার তালিকায়, পোলাও, মুরগি রোষ্ট, কোরমা, কাবাব, মাছ, চিংড়ি , ডিম, গরুর মাংস, ছাগলের মাংস, সবজি, দই, পায়েস, জর্দা, বোরহানি এবং কোমল পানীয়জলেরও ব্যবস্থা। কোথাও কোথাও খাওয়া শেষে মিষ্টি পানের ও আয়োজন থাকে। বিয়েতে এত পদের খাবারের আয়োজন করতে গিয়ে কোনো কোনো পরিবারের সারা জীবনের সঞ্চয় শেষ হয়ে যায়। অথচ টাকার অভাবে অনেক মেয়ের বিয়ে আটকিয়ে থাকে। খাবারের প্রতিটি প্লেট ভর্তি করে মেহমানদের পরিবেশন করা হয়। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ সব খাবার খেতে পারে না। কিছু কিছু খাবারের পদ ছুঁয়ে ও দেখে না। প্লেটেই রয়ে যায়। পরে খাবার গুলো চলে যায় ডাস্টবিনে। আজকাল ক্লাবকেন্দ্রীক বিয়ের আয়োজন হওয়ায় বরকনের অনেক দরিদ্র আত্মীয়, পাড়া প্রতিবেশী আসতে পারে না। ইচ্ছে থাকার পর ও সমাজের হতদরিদ্র মানুষ গুলো খাবারের সুযোগ পায় না। সমাজে একসাথে বসবাসের কারণে পড়শীদের প্রতি বরকনের পরিবারের সামাজিক দায়বদ্ধতা বাঙালী সংস্কৃতির চিরায়ত রীতি। গ্রামের বিয়েতে নিজস্ব পড়শীদের হক কতটুকু পালন করা হয়, ভেবে দেখার সময় হয়েছে। আগেকার সময়ে বিয়ের দায়িত্ব পালন করতো সমাজের স্থানীয় মুরুবীগণ। বর পক্ষের কিছু মানুষ কনের বাড়িতে গিয়ে কনে নিয়ে আসতো। খাওয়া দাওয়া হতো বরের বাড়ি। আবার খুবই কম সংখ্যক বিয়েতে বরসহ গিয়ে কনে আনতে যেতো। বিয়েতে এত খরচ হতো না। এত আইটেম রাখা হতো না। সব শ্রেণীর মানুষেরা মন ভরে খেতে পারতো। একমুঠো খাবার ও ডাষ্টবিনে যাবার সুযোগ ছিল না। অন্য দিকে যৌতুক বন্ধ নিয়ে আইন থাকলে ও সামাজিক সচেতনতা এবং কঠোর নজরদারির অভাবে যৌতুকের শিকড় গেঁড়ে বসে আছে অনেক গভীরে। বিভিন্ন আসবাবপত্র, ফ্রিজ, টেলিভিশন, স্বর্নের গহনা, নগদ টাকা, এমনকি গাড়িও।বিয়ের পর ও বিশেষ বিশেষ দিনে গরু ছাগল কাপড় সহ বিভিন্ন জিনিস দিতে হয়। পৃথিবীতে এখনো বহু মানুষ খেতে না পেয়ে উপোস থাকে, সেখানে এত ব্যয়বহুল বিয়ে অনুষ্ঠানের দরকার আছে কিনা অনেকেরই প্রশ্ন। খবরে প্রকাশ বিয়ে বাড়ির উচ্ছিষ্ট খাবার নিয়ে বাজার বসে জেলা শহর ফেনীর রেল স্টেশনের উত্তর পাশে। বিশেষ করে বিয়ে মৌসুমে শুক্রবার শনিবার বিকেলে এরকম হাট বসে। বিয়ে অনুষ্ঠানের বাবুর্চিরা খাবার গুলো হাটে নিয়ে এসে বিক্রি করে, অন্যান্য পন্যের মত। গরীব মানুষেরা সস্তায় এগুলো কিনে নিয়ে সন্তানদের খাওয়ায়। খাবার অপচয় নিয়ে কোরান মজিদের সুরা আ'রাফ,আয়াত ৩১; বলা হয়েছে যে,"তোমরা আহার কর,এবং পান কর। কিন্তু অপচয় করো না।অপচয়কারীদের আল্লাহ পছন্দ করেন না"।
হযরত আনাস (রাঃ) কতৃক হাদিস শরীফের বর্ণনা মতে, "নবীজি হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) খাওয়ার পর তার তিনটি আঙুল চেটে নিতেন। তিনি বলতেন তোমাদের কারো খাবারের লোকমা নিচে পড়ে গেলে সে যেন তাঁর ময়লা দুর করে তা খেয়ে নেয় এবং শয়তানের জন্য তা ফেলে না রাখে। (তিরমিজি ১৮০৩)।
জাতিসংঘের গবেষণা অনুযায়ী পৃথিবীর মোট উত্পাদিত খাদ্য পন্যের এক তৃতীয়াংশ খাদ্য অপচয় হয়।যার পরিমাণ ১৩০ কোটি টন।সম্প্রতি নভেম্বর ২০২২ হিসেব মতে বিশ্বের জনসংখ্যা ৮০০ কোটি প্রায়। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচীর পরিসংখ্যানে প্রকাশ ৮১ কোটি ১০লাখ মানুষ প্রতি রাতে খেতে না পেয়ে ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমিয়ে যায় । অন্য দিকে বাংলাদেশের নিরিখে রিপোর্টে প্রকাশ যে, বাংলাদেশে উচ্চ আয়ের প্রতিটি পরিবার মাসে ২৬ কেজি খাদ্য অপচয় করে থাকে।যাহা বছরের হিসেবে জনপ্রতি ৬৫ কেজিতে দাঁড়ায়। আধুনিক সভ্যতায় এই চিত্র চরম হতাশার, দায়িত্ব উদাসীনতার, খামখেয়ালিপনা এবং মানবিক মানষিক বিপর্যয় হিসেবে দেখছে সচেতন মহল। মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরব সহ অন্যান্য রাষ্ট্রেও প্রচুর খাদ্য অপচয় করে। তবে সেখানে বিয়ে অনুষ্ঠানে আমাদের দেশের মত আট,দশ আইটেমের খাবার করে না। ভাতের সাথে ছাগলের কিংবা উটের মাংস দিয়ে " মেন্দি" নামক আরব্য সংস্কৃতির আদলে একরকম খাবার তৈরী করে। সাথে কয়েক প্রকারের ফল এবং কোল্ড ড্রিংক।
প্রথা অনুযায়ী তাঁরা একটি বড় প্লেটে চার/পাঁচ জন করে খেতে বসে। প্লেটে যে খাবার রাখা হয় তা দশ জনেও খেয়ে শেষ করতে পারে না। তাই প্রতিটি প্লেটে অর্ধেকের মত খাবার নষ্ট হয়ে যায়। দক্কিণ এশিয়ার নাজুক অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্বের দারপ্রান্তে দাড়িয়ে থাকা পাকিস্তানের বিয়ের খাবারের আইটেমের মধ্যে শুধু মাত্র একটি আইটেম রাখার আইন করা আছে।
অমান্যকারীদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হয় এবং আইনটি কার্যকর নিয়ে প্রশাসনের সক্রিয় নজরদারি সবসময়ই মাঠে থাকে। ২০১৬ সাথে ইতালিতে এবং ২০১৭ সালে ফ্রান্সে খাবারের অপচয় রোধ নিয়ে আইন করা হয় যে,"সুপার মার্কেট কিংবা রেষ্টুরেন্টের অবিক্রিত খাবার ফেলে দেওয়া যাবে না। দাতব্য প্রতিষ্ঠান কিংবা গরীবের মাঝে দিয়ে দিতে হবে"। আইন অমান্যকারীদের জেল জরিমানার বিধান রেখে মেনে চলার জন্য কঠোর নির্দেশনা জারি করা হয়। গতকিছু দিন থেকে সত্তর দশকে বিয়ে করা খুলনার একজন বিশিষ্ট শিল্পপতির খবর নেট দুনিয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই তিনি বিমানে বরযাত্রী নিয়ে বিয়ে করেন। অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলতে পারদর্শী তিনি, বাংলা ও বুঝেন কিন্তু উর্দুতে কথা বলেন সবসময়।মইন নামীয় লোকটি আজ রাস্তার ফকির। পথে পথে ঘুরে বেড়ায়।লোকটি অপচয় এবং অপব্যয়ের একটি উদাহরণ হতে পারে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন বিভিন্ন বক্তৃতা বিবৃতিতে মন্দা এবং দুর্ভিক্ষের কথা বলছেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রকাশিত রিপোর্টে ও বলা হচ্ছে যে, "২০২৩ সালে বিশ্বের ৪৫টি দেশে তীব্র খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে। ৪৫ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নাম না থাকলেও বৈশ্বিক পরিস্থিতির আঘাত আমাদের ও এড়িয়ে যাবার নয়। গেল কিছু দিন আগে মহামারী করোনা বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। করোনা পরবর্তী বিশ্ব ঘুরে দাড়াঁতে গিয়ে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ "মরার উপর খাঁড়ার ঘা" হিসেবে চেপে বসে বিশ্বের অর্থনীতিরঘাঁড়ে। এই সংকট মোকাবিলা করার জন্য সাশ্রয়ী হয়ে সকলকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। বিপুল সংখ্যক জনসংখ্যার আমাদের দেশে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও বিয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। অনেকে বেহিসেবী খরচ করছে দেদারসে । এসব নিয়ে এই মুহূর্তে লাগাম টানা দরকার বলে মনে করছেন বিজ্ঞসমাজ।চিন্তাশীলদের অভিমত, সরকার এই নিয়ে আইন করতে পারে। "বিয়েতে বহু পদের খাবার নয়" সচেতনতা নিয়ে প্রচারণা চালাতে পারে।আবার শীতকালীন মৌসুমে দেশের প্রতিটি জায়গায় ওয়াজ মাহফিল হয়ে থাকে।মাহফিলে এসব বিষয়ে মানুষের মধ্যে বয়ান করা যেতে পারে। যৌতুক, খাদ্য অপচয়,ইত্যাদি খুবই খারাপ অভ্যাস, এবিষয়ে বেসরকারি সংস্থা গুলো ও দায়িত্ব শীল ভূমিকা পালন করতে পারে। এবিষয়ে সরকারি বেসরকারি সকলের সম্বলিত উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসা দরকার।
লেখক: কলামিস্ট ও সমাজকর্মী, সদস্য বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন কেন্দ্রীয় কমিটি।
© ২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | কর্পোরেট সংবাদ সম্পাদক - মোঃ মিজানুর রহমান । উপদেষ্টা সম্পাদক- জেসমিন আক্তার, এফসিএস ই-মেইলঃ corporatesangbad@gmail.com । ফোনঃ ০২২২-৩৩৫৪১২৫ । মোবাইলঃ ০১৭১১০৭৬৮১৫ অফিসঃ ৫৫/বি, নোয়াখালী টাওয়ার, ১১ তলা, সুইট ১১-এফ, পুরানা পল্টন, ঢাকা ১০০০ |
বিয়েতে বহুপদের খাবার রোধ, আইন ও সম্বলিত উদ্যোগ https://corporatesangbad.com/466046/ |