মো: মিজানুর রহমান, এফসিএস : বার কাউন্সিলের সদস্য না হলে কোর্টে দাঁড়ানো যায় না, রেজিস্টার্ড ডাক্তার না হলে চিকিৎসা সেবা দিতে পারে না কিন্তু কোন প্রফেশনাল বডির সদস্য না হয়েও বাংলাদেশে চিফ ফাইনান্সিয়াল অফিসার (সিএফও), কোম্পানি সেক্রেটারি (সিএস) এবং হেড অব ইর্টারনাল অডিট (এইচইএ) হওয়া যায়। এ যেন ডেন্টিস্ট না হয়েও দাঁতের ডাক্তার হওয়ার মত অবস্থা, আগের দিনের ধাত্রীদের মতো গাইনি ডাক্তার।
বিগত ২০ জুন ২০১৮ তারিখে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড একচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) একটি নোটিফিকেশনের মাধ্যমে নির্দেশনা দেয় যে, পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত কোম্পানিসমূহের প্রতি প্রান্তিক, অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক অনিরীক্ষিত ও নীরিক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করার পূর্বে সেটি অবশ্যই কোম্পানির সিএফও এবং কোম্পানি সেক্রেটারি (সিএস) কর্তৃক Authenticat বা প্রমাণীকরণ হতে হবে। নির্দেশনাটি খুবই সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত বলে বিএসইসিকে সংশ্লিষ্ট সবাই বাহবা দিল।
তার কিছুদিন আগেই ৩ জুন ২০১৮ বিএসইসি পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত কোম্পানিতে পরিপালনের জন্য ‘‘কর্পোরেট গভর্নেন্স কোড ২০১৮” ইস্যু করে নির্দেশনা দিয়েছে যে, প্রতিটি তালিকাভূক্ত কোম্পানিতে আবশ্যিক বা বাধ্যতামূলকভাবে সিএফও, কোম্পানি সেক্রেটারি (সিএস) এবং হেড অব ইন্টারনাল অডিট (এইচইএ) নিয়োগ দিতে হবে। খুবই ভালো খবর, পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সবাই সাধুবাদ জানালো বিএসইসির এই সিদ্ধান্তকে।
“কর্পোরেট গভর্নেন্স কোড ২০১৮” এর শুরুতেই বিএসইসি বলে দিলেন যে, সকল তালিকাভূক্ত কোম্পানিতে প্রতি ৫ জন পরিচালকের মধ্যে একজন স্বতন্ত্র পরিচালক বা ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডিরেক্টর থাকতে হবে। এবং খুবই যৌক্তিকভাবে স্বতন্ত্র পরিচালক হওয়ার যোগ্যতা পরিষ্কারভাবে সংশ্লিষ্ট কোডে উল্লেখ করে দেয়া হলো, যাতে চুলচেড়া বিশ্লেষণ করে প্রতিটি তালিকাভূক্ত কোম্পানিতে যথাযোগ্য স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয়। এবং কোম্পানির অডিট কমিটির চেয়ারম্যান ও এনআরসি কমিটির চেয়ারম্যানকে বাধ্যতামূলকভাবে হতে হবে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডিরেক্টর। খুবই ভালো সিদ্ধান্ত, বিএসইসিকে যুগোপযোগী সিদ্ধান্তের জন্য সংশ্লিষ্ট সবাই ধন্যবাদ জানালো।
প্রশ্ন হলো, কোম্পানিতে আসলে কি স্বতন্ত্র পরিচালকরা কোন কাজ করে, না কাজ করার সুযোগ আছে? অথচ তাদের থাকতে হবে এত এত যোগ্যতা যা না হলেই নয় ! আসলে এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য অবশ্যই গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করতে হবে সিএ, সিএমএ এবং সিএস ইনস্টিটিউট এর কাউন্সিলকে। অর্থ্যাৎ শুধু পদ বাধ্যতামূলক নয়, বাধ্যতামূলক করতে হবে স্বতন্ত্র পরিচালকের মতো নির্ধারিত যোগ্যতার পদ যেমন- সিএফও হতে আইসিএমএ এর সদস্য, সিএস হতে আইসিএসবি এর সদস্য এবং এইচইএ হতে আইসিএবি এর সদস্য হওয়া বাধ্যতামুলক করতে হবে।
আমাদের পাশের দেশ ভারতেও উল্লেখিত বিষয়গুলোতে সিকিউরিটিজ এন্ড একচেঞ্জ কমিশনের পাশাপাশি ইন্ডিয়ান কোম্পানি ‘ল’ তে এ বিষয়ে পরিষ্কার নির্দেশনা রয়েছে। সাথে উল্লেখ রয়েছে বাধ্যতামূলকভাবে নিয়োগ পাওয়া কর্পোরেট প্রফেশনালদের নির্ধারিত যোগ্যতার বিষয়টিও। যেমন- সিএফও, সিএস এবং এইচইএ প্রতিটি কোম্পানিতে বাধ্যতামূলকভাবে নিয়োগ দিতে হবে এবং যাদেরকে নিয়োগ দেওয়া হবে তাদেরকে অবশ্যই ভারতের সিএ এবং সিএস ইনস্টিটিউটের সদস্য হতে হবে। সেখানে ইনস্টিটিউটের সদস্য না হয়ে কারো পক্ষেই তালিকাভূক্ত কোম্পানির সিএফও, সিএস এবং এইচইএ হওয়ার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের কেউ চেষ্টা করে দেখুক তো ভারতে গিয়ে সিএফও, সিএস এবং এইচইএ হতে পারে কি না? পদ্ধতিগত কারণে এবং শুধুমাত্র ভুল কর্পোরেট নীতির কারনেই অন্য দেশের লোকেরা আমাদের দেশে এসে বিদেশী মালিকানাধীন কোম্পানিতে দখল করছে ঐসব গুরুত্বপূর্ণ পদ।
অথচ বিএসইসির তৎকালীন কমিশন বাংলাদেশে সকল তালিকাভূক্ত কোম্পানিতে সিএফও, সিএস এবং এইচইএ নিয়োগ বাধ্যতামূলক করলেও তাদের কোন যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেননি যে, কারা কোন যোগ্যতাবলে সিএফও, সিএস এবং এইচইএ পদে নিয়োগ পাবেন। ফলে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলোতে তৈরী হয়েছে একটি কর্পোরেট হ-য-ব-র-ল অবস্থা। অর্থ্যাৎ নন প্রফেশনাল মেনেজমেন্ট নিয়োগ দিচ্ছে সব নন প্রফেশনাল সিএফও, সিএস এবং এইচইএ। ফলে সিএ, সিএমএ এবং সিএস প্রফেশন থেকে কোয়ালিফাই করা অনেক যোগ্যতা সম্পন্ন পেশাদার সদস্য যোগ্যতা মাফিক কাজ পাচ্ছেন না। কারণ প্রতিমাসে ৫০ হাজার টাকায় যদি সিএফও বা সিএস পাওয়া যায় তাহলে কেন কোম্পানির মেনেজমেন্ট আড়াই লাখ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা খরচ করে প্রফেশনাল বডির সদস্যদের সিএফও এবং সিএস পদে নিয়োগ দিবে? ফলে পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত অধিকাংশ কোম্পানিই এখন নন প্রফেশনাল সিএফও এবং সিএসরাই কোম্পানির ফাইন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্ট Authenticat বা প্রমাণীকরণ করছেন। সুতরাং বিএসইসির উদ্দেশ্য ভালো হলেও তাদেরই ভূলের কারণে তালিকাভূক্ত কোম্পানির আর্থিক বিবরণী নিয়ে বিনিয়োগকারীদের এখনও হতাশা কাটেনি, যে কারণে মার্কেট স্বাভাবিক হচ্ছে না।
মজার ব্যাপার হলো কোম্পানিতে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডিরেক্টর কোন ডকুমেন্ট Authenticat বা প্রমাণীকরণ করে না। শুধু বোর্ড মিটিংয়ে বসাই যাদের কাজ তাদের ক্ষেত্রে কিন্তু নির্ধারিত যোগ্যতা ঠিকই কর্পোরেট গভর্নেন্স কোড ২০১৮ তে স্পষ্ট করা হয়েছে এবং তৎকালীন কমিশনের ভূলের বোঝা বিএসইসির বর্তমান কমিশনও বয়ে বেড়াচ্ছে। প্রায় দুই বছরের অধিক সময় গেলেও বিগত কমিশনের কর্পোরেট গভর্নেন্স কোড ২০১৮-তে থাকা ভূলগুলো বর্তমান কমিশন এখনও সংশোধনের কোন পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে কানা ছেলের নাম হয়ে যাচ্ছে, “পদ্মলোচন”।
বিএসইসির বর্তমান কমিশনের কাছে এই প্রেক্ষিতে সবিনয় জিজ্ঞাসা, পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত কোম্পানিতে সিএ, সিএমএ এবং সিএস প্রফেশনের তালিকাভূক্ত সদস্যরা কবে থেকে গর্ব করে বলবে যে, কোন প্রফেশনাল বডির সদস্য না হলে বাংলাদেশেও কোন তালিকাভূক্ত কোম্পানির সিএফও, সিএস এবং এইচইএ হওয়া যায় না। এবং কেবল তখনই বন্ধ হবে বিদেশী কোম্পানিগুলোর দেশের বাইরে থেকে আমদানি করা লোকদের দিয়ে সিএফও, সিএস এবং এইচইএ পদে নিয়োগ বাণিজ্য। কর্পোরেট প্রফেশনালদের কাজের ক্ষেত্রে তৈরী হবে নিরাপত্তা। কথায় কথায় কোম্পানির সিএফও, সিএস এবং এইচইএদের অকারণে চাকুরি ছাড়তে হবে না। এতে সকল ক্ষেত্রে তৈরী হবে সবার জবাবদিহিতা এবং নিশ্চিত হবে কর্পোরেট সেক্টরের সকল পর্যায়ের সু-শাসন।
অন্যথায় “যে লাউ সেই কদু” অবস্থা রয়ে যাবে কর্পোরেট সেক্টরে, ফলে প্রতিষ্ঠিত হবে না কর্পোরেট সু-শাসন। কথায় কথায় চাকরি যাবে কর্পোরেট প্রফেশনালদের কাজেই প্রতিষ্ঠিত হবে না কমপ্লায়েন্স ও জবাবদিহিতা।
অতএব, ‘‘কর্পোরেট গভর্নেন্স কোড ২০১৮” তে সংশোধনী এনে উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশেও কর্পোরেট সুশাসন প্রতিষ্ঠায় পেশাদারদের কাজের ক্ষেত্রে শুধু জবাবদিহিতা নয়, কর্মক্ষেত্র হতে হবে নিরাপদ ও টেকশই। যে জন্য অবশ্যই সকল তালিকাভূক্ত কোম্পানিতে সিএফও, সিএস এবং এইচইএ নিয়োগ শুধু বাধ্যতামূলক নয়, বাধ্যতামূলক করতে হবে সিএ, সিএমএ এবং সিএস ইনস্টিটিউট এর সদস্যদের নিয়োগ, তবেই প্রতিষ্ঠা পাবে কর্পোরেট সুশাসন। আর এ জন্য বিএসইসিকে নিতে হবে ইতিবাচক প্রদক্ষেপ এবং সিএ, সিএমএ এবং সিএস ইনস্টিটিউট এর কাউন্সিলকে নিতে হবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
লেখক: সম্পাদক, কর্পোরেট সংবাদ ; ফেলো, আইসিএসবি ও কলামিস্ট।
© ২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | কর্পোরেট সংবাদ সম্পাদক - মোঃ মিজানুর রহমান । উপদেষ্টা সম্পাদক- জেসমিন আক্তার, এফসিএস ই-মেইলঃ corporatesangbad@gmail.com । ফোনঃ ০২২২-৩৩৫৪১২৫ । মোবাইলঃ ০১৭১১০৭৬৮১৫ অফিসঃ ৫৫/বি, নোয়াখালী টাওয়ার, ১১ তলা, সুইট ১১-এফ, পুরানা পল্টন, ঢাকা ১০০০ |
কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন, কেন? https://corporatesangbad.com/454456/ |