পাহাড়ের বুকে ‘হামহাম’, জলপ্রপাত যেন মুগ্ধতার প্রতিচ্ছবি

Posted on September 1, 2023

তিমির বনিক, ষ্টাফ রিপোর্টার: পাহাড়ের বুকে দিগন্ত জোড়া অবারিত সবুজের সমারোহ। একে তো ঘন জঙ্গল, তার ওপর উঁচুনিচু পাহাড়ি রাস্তা সুনিপুণ ভাবে গহীন জঙ্গল। সুনসান এই পাহাড়ি রাস্তা ধরে কমপক্ষে ৩ ঘণ্টা হাঁটলে দেখা মিলবে নৈসর্গিক এক জলপ্রপাতের—ছলছল শব্দে আঁকাবাঁকা পথে বয়ে চলা পাহাড়ি জলপ্রপাত। ঝুম বৃষ্টি পাহাড়ি রাস্তাকে আরও ভয়ানক করে রেখেছে। একটু অসাবধান হলেই সোজা ১২০ ফুট নিচে!

স্বচ্ছ জলধারা গড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ের শরীর জুড়ে। সেই টলমলে স্বচ্ছ জলধারা গড়িয়ে পড়ছে ১৫০ থেকে ১৬০ ফুট উপর থেকে। নির্জন পাহাড়ের ওপর থেকে আছড়ে পড়া স্রোতধারা শাঁ, শাঁ শব্দ বয়ে যাচ্ছে সমতলে। সেই সৃষ্ট জলকনা তৈরি করছে কুয়াশার আবরণ। কলকল পানির শব্দ গহীন বনপাহাড়ি জায়গাটিকে আরও মোহনীয় করে রেখেছে। এই অদ্ভুত রোমাঞ্চকর পরিবেশ থেকে একবারের জন্যও চোখ ফেরানো যায় না। 

নির্জন, শান্ত পাহাড় থেকে কলকল শব্দ বয়ে যাচ্ছে সমতলে। পাখির ডাক শুনতে শুনতে, বুনো ফুলের গন্ধে মাতাল হয়ে, বাঁধনহারা বাতাসে নাম না জানা লতাপাতা, গুল্ম, বাঁশবন ও ফলের গাছ উদ্দাম নৃত্য দেখতে দেখতে পদব্রজে ভ্রমণের সেই আনন্দ শহুরে জীবনে কংক্রিটের পথে কই? 

স্থানীয়রা এ জলপ্রপাতকে হামহাম বলেই ডাকেন। স্থানীয়দের মতে, আরবি ‘হাম্মাম’ (গোসলখানা) শব্দ থেকে এই জলপ্রপাতের নাম হামহাম নির্ধারণ করা হয়েছে। আবার আদিবাসীদের উপভাষায় ‘আ-ম আ-ম’ বলে পানির প্রবল বেগে পানি পড়ার শব্দকে বোঝানো হয়। তাই অনেকে ধারণা করেন এই উপভাষা থেকেই 'হামহাম' নামের উৎপত্তি। মজার বিষয় হচ্ছে হামহাম ছাড়াও এই জলপ্রপাতের আরেকটি নাম আছে। স্থানীয়ভাবে একে 'চিতা ঝরনা' বলেও ডাকা হয়।

মৌলভীবাজারেরর কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের কুরমা বনবিট এলাকায় হামহাম জলপ্রপাতের অবস্থান। 

নামের মতোই ভয়ানক ও আশ্চর্য সৌন্দর্যে আবৃত এই জলপ্রপাত। বনের শুরুতেই দুটি রাস্তা পাওয়া যাবে। ডান দিকের রাস্তা দিয়ে যাওয়া সুবিধাজনক। ঢুকতেই জানা-অজানা অনেক ধরনের গাছ চোখে পড়বে। দেখা মিলবে নানা প্রজাতির বাঁশ। মাঝেমধ্যেই ছোট ছোট বাঁশের সাঁকো পার হতে হবে। 

যাওয়ার পথে চোঁখে পড়বে সারি সারি কলাগাছ, জারুল, চিকরাশি, কদমসহ নানা প্রজাতির গাছ। যেতে যেতে এই পাহাড়ি পথ এক সময় স্বচ্ছ জলের স্রোতে নামিয়ে দিবে। জলের নিচে তাকাতেই চোখে পড়বে বিশাল বিশাল পাথর! জলস্রোতের উৎপত্তি হামহাম জলপ্রপাত থেকে। এই স্রোত বেয়ে বেয়েই একটা সময় আপনি পৌঁছে যাবেন হামহামের পাদদেশে। তবে বলে রাখা ভালো, এই ঝরনার যৌবন দেখতে হলে বর্ষাকালে যাওয়া বাঞ্ছনীয়।

হামহাম যাওয়ার সময় কলাবনপাড়া থেকে একজন গাইড সঙ্গে করে নেওয়া ভালো। কমলগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে ইসলামপুর ইউনিয়নের কলাবনপাড়া হলো কমলগঞ্জ উপজেলার শেষ গ্রাম। এর পাশেই ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তরেখা। এখানে সরাসরি পৌঁছানোর কোনো রাস্তা নেই। উপজেলার চৌমুহনা চত্বর থেকে কুরমা চেকপোস্ট পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার পাকা রাস্তায় গাড়িতে করে যেতে পারলেও বাকি পাহাড়ি পথ পায়ে হেঁটে যেতে হয়। পায়ে হেঁটে ৪-৫ কিলোমিটার ভেতরে সীমান্ত ঘেঁষে ত্রিপুরা আদিবাসীদের পল্লী ও কুরমা বনবিটের অরণ্য ঘেরা দুর্গম পাহাড়ি এলাকা তৈলংবাড়ি পর্যন্ত যাওয়া যায়। সেখান থেকে মূল জলপ্রপাত প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে।

প্রকৃতিপ্রেমীদের গহীন অরণ্য প্রবেশ করে জলপ্রপাত দেখতে হলে তৈলংবাড়ি বা কলাবন বস্তির আদিবাসীদের সাহায্য নিতে হয়। পাহাড়ি আঁকা-বাঁকা, উঁচু-নিচু পথে ট্রেকিং করা খুবই কষ্টের। পিচ্ছিল রাস্তাটি সতর্ক হয়ে চলাফেরা করতে হয়। ট্র্যাকিংয়ের সময় সবাইকে ভারসাম্য রক্ষার্থে বাঁশের লাঠি হাতে নিতে হয়। এ জলপ্রপাতটিতে যেতে পেরোতে হয় দুর্গম পাহাড়ি সরুপথ। পাহাড়ি ঝিরি ধরে হাঁটতে হয় বহুদূর। ঝিরিপথে পড়বে কখনও হাঁটু কিংবা কোমর পানি। জলপ্রপাতের অর্ধ-কিলোমিটার দূর থেকেই শুনা যায় ঝর্ণার জলধ্বনী। শুষ্ক মৌসুমে ঝর্ণার পানি কম থাকলেও বর্ষা মৌসুমে পানি বেড়ে যায়।

পুরো রাস্তাটি যেহেতু ঘন পাহাড়ি জঙ্গলের মধ্য দিয়ে, তাই একজন গাইড সঙ্গে থাকলে পথ হারানোর সম্ভাবনা থাকবে না। এমনকি চাইলে যেকোনো ধরনের সাহায্যও পাওয়া যাবে। কারণ জঙ্গলের মধ্যে মোবাইল নেটওয়ার্ক পাওয়া তো দূরের কথা, মানুষের দেখা পাওয়াও মুশকিল। সঙ্গে জোঁক ও সাপের উপদ্রব তো আছেই। তাই হাঁটার জন্য হান্টিং বুট পরে নেওয়া ভালো। হাতে রাখার জন্য চিকন বাঁশের লাঠি নেওয়া যেতেই পারে। এগুলো কলাবনপাড়াতে পাওয়া যাবে। আরেকটি কথা, দীর্ঘ পাহাড়ি পথে কোনো ধরনের দোকানপাট নেই, তাই সঙ্গে করে শুকনা খাবার, স্যালাইন, পানি ও লবণ রাখা হবে বুদ্ধিমানের কাজ।

২০১০ সালের শেষের দিকে পর্যটন গাইড শ্যামল দেববর্মার সঙ্গে দুর্গম জঙ্গলে ঘোরা একদল পর্যটক আবিষ্কার করেন। এরপর থেকেই এটি বিখ্যাত হয়ে উঠে। কিন্তু স্থানীয়দের মতে এই জলপ্রপাত সম্পর্কে তারা আরও আগে থেকেই জানতেন। ২০১১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নেতৃত্বে একটি দল সরেজমিনে হামহাম জলপ্রপাতটি পরিদর্শন করেন। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক বিবরণ কিংবা পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।

ধারণা করা হয়ে থাকে, দেশে অবস্থিত অন্যান্য জলপ্রপাতের তুলনায় এটি প্রশস্ততম। প্রায় ৩০ ফুট প্রশস্ততা বিশিষ্ট এবং ১৩৩ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট এ জলপ্রপাতটি। দিনদিন রোমাঞ্চকর অভিযাত্রীদের এক তীর্থভূমি হয়ে উঠেছে। ক্রমাগত পর্যটক সংখ্যা বাড়ছেই। ইতিমধ্যে সরকারি উদ্যোগে অবকাঠামো এবং যোগাযোগের সুবিধা বাড়াতে বেশ কিছু কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যতা এবং রোমাঞ্চকর পরিবেশ নিঃসন্দেহে একে বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন স্থান রূপ নিবে।

হামহামে সৌন্দর্যে একদিনে মনে তৃপ্তি আসবেনা জানিয়ে চট্রগ্রাম থেকে আসা আরিফ হোসেন বলেন, ওখানে গেলে ইচ্ছে হবে না চোখ সরাতে। মনে হবে, অনন্তকাল দু'চোখ ভরে দেখে নেই প্রকৃতির এই অপূর্ব সৃষ্টিকে। এই অদ্ভুত এক রোমাঞ্চকর পরিবেশে ভুলে যাবেন যে কোথায় আছেন।

সদ্য হামহাম ঘুরে আসা জেলা শহরের সঞ্জিব দাস বলেন, যতো উৎফুল্লতা সহ রওনা দিয়েছিলাম ঠিক ততো তাড়াতাড়িই উচ্ছ্বাস হারিয়ে ফেললাম যখন মাঝপথে বৃষ্টি নামতে শুরু করে। বৃষ্টিতে পাহাড়ী পথ পিচ্ছিল হয়ে যায়। তবে মাথায় তখনও জলপ্রপাত দেখার নেশা কাজ করছিল। কষ্ট করেই গেলাম। ভাবলাম যাই হোক, ঝর্ণাতে যেতেই হবে। কিছুক্ষণ হাঁটার পর কানে ভেসে আসতে শুরু করল ঝর্নার শব্দ। ভয়ংকর সেই সৌন্দর্য সামনে দেখতে পেরে যেন সব কষ্ট সার্থক।

স্থানীয় সংস্কৃতিমনা সাজু দেব বলেন, চারদিকে গাছগাছালি ও প্রাকৃতিক বাঁশবনে ভরপুর এ বনাঞ্চল। পাথুরে পাহাড়ের ঝিরি পথে হেঁটে যেতে যেতে সুমধুর পাখির কলরব আপনার মনকে ভাললাগার অনুভূতিতে ভরিয়ে দেবে। কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর শুরুতে আপনার দু’চোখের সামনে ভেসে উঠবে পাহাড় থেকে ধোঁয়ার মতো ঘন কুয়াশা ভেসে উঠার অপূর্ব দৃশ্য। মনে হবে যেন ওই নয়নাভিরাম পাহাড় আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

কমলগঞ্জের স্থানীয় বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন জানান, ভোর হতেই এখানে পর্যটকরা আসতে থাকেন। কিন্তু সবাই হামহাম যাওয়াতে সফল হন না। অনেকেই কিছু রাস্তা পাড়ি দেওয়ার পর ফিরে আসেন। রাস্তায় কয়েক দফায় বেশ কিছু আগত পর্যটক ক্লান্ত হয়ে কাঙ্ক্ষিত ঝর্ণা না দেখেই বাড়ির পথে রওয়ানা দেন। মূলত তরুণরাই হামহাম যাওয়ার দৌড়ে এগিয়ে। ঘুরতে আসা পর্যটকদের মধ্যে ৮০ ভাগই তরুণ-তরুণী। দৃঢ় মনোবল থাকলে হামহাম জলপ্রপাতের রূপ দেখা সম্ভব।

বন বিভাগের কমলগঞ্জ রাজকান্দি রেঞ্জ কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম বলেন, এই বর্ষা মৌসুমে বনে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে। এতে হামহাম ঝরনায় পানি শীতের চেয়ে দ্বিগুণ। হামহাম পর্যটককেন্দ্রের উন্নয়ন করার জন্য বন বিভাগ থেকে বিভাগীয়ভাবে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।