গ্যাস-বিদ্যুৎ ও কৃষি খাতের সঙ্কট নিরসন অতিব জরুরি

Posted on July 24, 2022

মোঃ শাহাদাৎ হোসেন মুন্না : বিশ্ববাজারে গ্যাস বিদ্যুৎ সঙ্কটের কারণে সম্প্রতি সারাদেশে লোডশেডিংয়ের আওতায় আনা হয়েছে। এলাকাভেদে সময় নির্ধারণ করে লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে। লোডশেডিংয়ের পাশাপাশি দেশে এবার গ্যাস সঙ্কটও দেখা দিয়েছে। পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহের অভাবে গত ১৯ জুলাই চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড সার কারখানাটিতে সার উৎপাদন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এতে দেশে নতুন করে কৃষি সঙ্কট তৈরি হচ্ছে। সম্প্রতি এই খাতে কিছু সঙ্কটের ভয়াবহ চিত্র আমাদের সামনে চলে আসছে। এমন সঙ্কট তৈরির পেছনে কারা তা খতিয়ে দেখা দরকার।

আমাদের দেশে রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে ঘিরে বালিশ কান্ড ঘটেছিলো। ছয় হাজার টাকার একটি বালিশ ভবনে উঠাতে খরচ এক হাজার টাকা। এমন হিসাব দেখে অনেকেরই চোখ কপালে উঠেছিল। গ্রিনসিটি আবাসন প্রকল্পের ২০ ও ১৬ তলা ভবনের প্রয়োজনীয় মালামাল কেনা ও ভবনে তোলার কাজে অস্বাভাবিক ব্যয় নিয়ে বছরের মাঝামাঝিতে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দুর্নীতির এই চিত্র বেরিয়ে আসে। পরে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে এমন নয়-ছয়ের গল্প প্রকাশ্যে আসে৷ এমন কান্ড ছাড়াও আমাদের দেশে পেঁয়াজ কান্ডও শুরু হয়েছিলো। তখন আতঙ্কের নাম ছিল পেঁয়াজ৷ নিজেদের বাজার সামলাতে সেপ্টেম্বরে ভারত সরকার হঠাৎ করেই পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিলে দেশের বাজারে সঙ্কট তৈরী হয়৷ রাতারাতি পেঁয়াজের দাম পাঁচ/ছয় গুণ বেড়ে যায়৷ জ্যামিতিক হারে এই দাম বাড়তে বাড়তে কেজি ২৫০ টাকা পর্যন্ত উঠে যায়৷ এই সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী পেঁয়াজ মজুদ করে বাজার আরও বেসামাল করে দেন৷ এরপর শুরু হয় সয়াবিন তেল কান্ড। তেলের এমন কারসাজি দৃশ্যমান হয়। এরপরই আস্তে আস্তে শুরু হলো সঙ্কট। লুটপাটে জড়িয়ে পড়ে অনেকেই। কিছু লোকের লুটপাটের কারণেই আজ আমাদের এই বেহাল দশা।

সারাদেশে যখন অর্থ লুটপাট হয়। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে খেলাপী করে বিদেশে অর্থ পাচার করে ভিনদেশে অট্টালিকা গড়ে তুলে। ঠিক তখনই দেশের কৃষকদের দেওয়া ১০-২০ হাজার টাকা ঋনের জন্য ঋণদাতা ব্যাংকগুলো মামলা ঠুকে দেয়। অথচ হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়া সেই রাঘবদের বিরুদ্ধে আমাদের চোখে পড়ার মতো কোন ব্যবস্থাই নেওয়া হয় না। আমাদের দেশে বহুতল প্রকল্পের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা বাজেট পাশ করা হয়। কিন্তু দেশে খাদ্য শষ্য উদৎপাদন করা কৃষি খাতের জন্য আরও বাজেট বাড়ানো যায়।

তাছাড়া গরীব অসহায় কৃষকদের ধোঁকা দিয়ে সেই ঋণ একটি চক্র হাতিয়ে নিয়ে কৃষকদের বঞ্চিত করে। গ্রামে এমন অনেক কৃষক রয়েছে, যারা কৃষি ঋণতো দূরের কথা উল্টা কৃষকের নামে বরাদ্ধ হওয়া বীজও অনেকের কপালে জুটে না। গ্রামাঞ্চলে দেখা যায়, অধিকাংশ কৃষকের ফলানো ফসলের ক্ষেতের উপর নতুন রাস্তা বাঁধতে মাটি গর্ত করে রাস্তায় তোলাসহ নানান প্রকল্পের নামে কৃষি ফসল নষ্ট করা হয়। তখন ওই গরীব কৃষকের ফলানো ফসল আর গোলায় তোলা হয়না। বড় গর্ত আর মেশিনের চাপে ক্ষেতের মধ্যেই ফসল নষ্ট হয়ে যায়। এমন অত্যাচার ও নির্যাতনের মাঝে যখন কৃষকদেরকে দেওয়া সরকারী সামান্য সহায়তার হরিলুট হয়। ঋণের নামে ব্যাংকগুলো তাদের শোষন করে। তখন কৃষিক্ষেত বন্ধ করা ছাড়া কৃষকদের আর কিছু করার থাকেনা। তখনই দেখা যায়, কৃষি প্রধান এলাকাগুলোতে জমি পরে থেকে আগাছা জন্মায়। কয়েকদিন পর সেই কৃষি জমিটি ভিটে বাড়ীতে রূপান্তর করা হয়। এভাবেই কৃষিজমিগুলো আস্তে আস্তে সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, মহামারীর দুবছরে সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, কৃষি ও রাকাব সরকারি এই ছয় ব্যাংক মিলে কৃষকদের বিরুদ্ধে ৭ হাজার ৮০০টি মামলা করেছে। একই সময়ে রেকর্ডসংখ্যক মামলা নিষ্পত্তিও হয়েছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে কৃষকদের বিরুদ্ধে অনিষ্পন্ন সার্টিফিকেট মামলার সংখ্যা ছিল সোয়া লাখের বেশি। তথ্য অনুযায়ী, কৃষকের বিরুদ্ধে ২০২০ ও ২০২১ সালে সবচেয়ে বেশি মামলা করেছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। গত দুই বছরে বিশেষায়িত এ ব্যাংকটি ৫ হাজার ২৩টি মামলা করেছে। এর মধ্যে ২০২০ সালে ২ হাজার ৭৯৮টি ও ২০২১ সালে ২ হাজার ২২৫টি। এর পরই রয়েছে সোনালী ব্যাংক। এ ব্যাংকের মাধ্যমে গত দুবছরে মামলা হয়েছে ১ হাজার ৬৫৯টি। এর মধ্যে ২০২০ সালে ৩৭৮টি ও ২০২১ সালে ১ হাজার ২৮১টি। এ ছাড়া গত দুই বছরে অগ্রণী ব্যাংক ১৯৯টি মামলা করেছে। এর মধ্যে ২০২০ সালে ১১৫টি ও ২০২১ সালে ৮৪টি।

অন্যদিকে আমাদের দেশে রাঘব-বোয়ালরা অর্থ পাচার করে বিদেশে পাড়ি জমায়। হরিলুটের পাচার করা টাকা দিয়ে ভিনদেশে অট্টালিকা গড়ে তুলে। দেশ থেকে কি পরিমান অর্থ হরিলুট করে বিদেশে পাচার করা হয়। তার একটি প্রমান উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) এর প্রতিবেদনে। ২০২০ সালের ৪ মার্চ গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির দেওয়া একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়। বর্তমান বাজারদরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা।

এছাড়াও, প্রতিবেদনটিতে ১৩৫টি উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশের গত ১০ বছরের (২০০৮-২০১৭) আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মূল্য ঘোষণার গরমিল দেখিয়ে কীভাবে দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়, সেই চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৪৮ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকা, যা এ খাতে বিতরণ করা ঋণস্থিতির ৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ। অন্যদিকে গত বছর পর্যন্ত শিল্প খাতে ঋণস্থিতি ৬ লাখ ২৮ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ৪৯ হাজার ২৬২ কোটি টাকা, যা এ খাতে বিতরণ করা মোট ঋণস্থিতির ৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ।

এমন হরিলুটের মধ্যে আমাদের দেশের কৃষকদের বিরুদ্ধেই নিয়মীত মামলা হচ্ছে। অথচ কৃষকরা নেওয়া ১০/২০ হাজার টাকা ঋণ পরিশোধতো করছেই। পাশাপাশি ঋণের লভ্যাংশও কিন্তু পরিশোধ করে নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। তবে কৃষক আর রাঘব-বোয়ালদের ঋণের মধ্যে আকাশ পাতাল ফারাক থাকলেও অসাধূ কিছু ব্যাংক কর্মকর্তার লাভ লোকসানের হিসাব কিন্তু এঋণের মধ্যেই লুকায়িত। অভিযোগ আছে যে, ব্যাংক কর্মকর্তারা রাঘব-বোয়ালদের বড় বড় ঋণ পাশ করে বিশাল একটা পারসেন্ট ভাগিয়ে নেয়। তাদের এমন দুর্নীতি বন্ধে সরকারের সুদৃষ্টি প্রত‍্যাশা করছি।

লেখক: ভাইস চেয়ারম্যান সৃষ্টি হিউম্যান রাইটস সোসাইটি ও মহাসচিব বাংলাদেশ ক্যাবল টিভি দর্শক ফোরাম।