স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পরে বদলে যাবে দক্ষিণাঞ্চল

Posted on June 11, 2022

এস এল টি তুহিন, বরিশাল : আগামী ২৫ জুন স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জীবনযাত্রা, অর্থনীতি আর যোগাযোগের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের আশায় স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে ঘিরে ক্ষণগণনা শুরু করেছেন বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। পদ্মা সেতুকে ঘিরে ইতোমধ্যে গোটা দক্ষিণাঞ্চলে নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। নিরবিচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগের কারণে সময়ের পাশাপাশি কমাবে পণ্য পরিবহনের খরচ। স্থানীয় অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলেছেন, যাতায়াতে নদীর সহজ লভ্যতা, আকাশ পথ আর এখন পদ্মা সেতুর কারণে ফেরী বিহীন সড়ক বরিশালের ব্যবসা বাণিজ্যে আমূল পরিবর্তন ঘটনাবে।

বদলে যাবে দক্ষিণাঞ্চল।। বর্তমান সরকারের নেওয়া একাধিক মেগা প্রকল্পের উন্নয়নের সাথে স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর পরই বদলে যাবে একসময়ের অবহেলিত দক্ষিণাঞ্চলের চিত্র। একদিকে দক্ষিণাঞ্চলের মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নসহ ব্যাপক উন্নয়ন, অন্যদিকে সারাদেশের সাথে ফেরীবিহীন যোগাযোগব্যবস্থা চালু হবে দেশের সর্বদক্ষিণের সাগরকন্যা কুয়াকাটার সাথে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমান সরকারের হাতে নেওয়া বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন দেখে ইতোমধ্যে বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকরা শত শত একর জমি ক্রয় করেছেন। পায়রা বন্দর, পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, সাবমেরিন ক্যাবল ল্যান্ডিং স্টেশন, দৃষ্টিনন্দন ফোর লেনের পায়রা সেতুর পাশাপাশি শেরে বাংলা নৌ-ঘাঁটি ও ইপিজেড স্থাপিত হলে পুরো দক্ষিণাঞ্চল পরিণত হবে অর্থনৈতিক জোনে। পায়রা সমুদ্র বন্দরের নিরাপত্তা এবং ব্লু-ইকোনমি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য কলাপাড়ার লালুয়ায় শেরে বাংলা নৌ-ঘাঁটি স্থাপনে কাজ শুরু হয়েছে। সবমিলিয়ে একসময়ের অবহেলিত দক্ষিণাঞ্চলে উন্নয়নের মহাসড়কে বাকি রইল শুধু রেলপথ ও গ্যাস।

উন্নয়ন সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পদ্মা সেতু দিয়ে ট্রেন যাবে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত। সেলক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতায় দক্ষিণাঞ্চলবাসী রেলপথ ও গ্যাস পাবেন বলেও শতভাগ আশাবাদী।

ব্যবসা-বাণিজ্যের অপার সম্ভাবনাময় দক্ষিণাঞ্চলে সৃষ্টি হবে নতুন নতুন কর্মসংস্থান। সারাদেশ থেকে পর্যটকদের কুয়াকাটায় আসতে কক্সবাজারের চেয়ে কম সময় লাগবে। ফলে পর্যটকদের আগমনে জমে উঠবে কুয়াকাটা। সবকিছু মিলিয়ে দেশের অর্থনীতিতে যোগ হবে নতুন মাত্রা।

সূত্রমতে, লেবুখালীর পায়রা সেতুর উত্তরপ্রান্তে স্থাপিত হয়েছে শেখ হাসিনা সেনানিবাস। দক্ষিণপ্রান্তে দুমকীতে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। মহাসড়কের পাশে রয়েছে কৃষি গবেষণা কেন্দ্র। পায়রা সেতু থেকে মহাসড়কের আশপাশের এলাকায় শিল্প-কলকারখানা স্থাপনে জমি কেনার হিড়িক চলছে দেশের বড় বড় শিল্প মালিকদের। শহরের পাশেই স্থাপিত হয়েছে কোস্টগার্ড সিজি বেইজ অগ্রযাত্রা ঘাঁটি। পটুয়াখালী-কলাপাড়া মহাসড়ক থেকে পায়রা বন্দর পর্যন্ত সাড়ে চার কিলোমিটার ফোর লেন সড়ক স্থাপন, মহাসড়ক থেকে তাপবিদ্যুত কেন্দ্র পর্যন্ত ছয় লেন মহাসড়কের কাজ এগিয়ে চলছে দ্রুতগতিতে। পটুয়াখালী-কুয়াকাটা মহাসড়কের সদর উপজেলার আউলিয়াপুর এলাকায় ইপিজেড স্থাপনে জমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পায়রা সেতু থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত মহাসড়কের আশপাশে দেশের ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকরা জমি ক্রয় করেছেন। পায়রা বন্দর এলাকার আশপাশে জমি ক্রয় করেছে মদিনা গ্রুপ ও এমএম বিল্ডার্স নামের প্রতিষ্ঠান। সাগরকন্যা কুয়াকাটায় ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে শতাধিক হোটেল-মোটেল। পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটার খাজুরা, গঙ্গামতী, কাউয়ার চর ও এর আশপাশে জমি ক্রয় করেছেন সিকদার গ্রুপ, ইউএস বাংলা, সেঞ্চুরি, বসুধা, ওয়েস্টার্নসহ কমপক্ষে ১৫টি ভারী শিল্পমালিক। এসবস্থানে কোম্পানিগুলো নির্মাণ করবে বিভিন্ন ধরনের শিল্প-কলকারখানা ও বহুতল ভবন। কুয়াকাটায় নির্মাণের অপেক্ষায় রয়েছে ১৭ তলা ভবনের ওয়াচ টাওয়ার। সরকারের মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় হবে আধুনিক পর্যটন এলাকা কুয়াকাটা। থাকবে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, স্টেডিয়ামসহ বহু স্থাপনা।

বরিশাল বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণাঞ্চলের পায়রা থেকে কুয়াকাটার বিস্তৃত এলাকা ঘিরে পর্যটনভিত্তিক উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি সমন্বিত মাস্টারপ্ল্যান করতে যাচ্ছে সরকার। যার মনিটরিং করছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। মাস্টারপ্ল্যানে থাকছে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, আধুনিক পর্যটন স্থাপনা, শিল্পভিত্তিক বন্দরনগরী, পরিকল্পিত নগরায়ণ, যোগাযোগ, অর্থনীতি ও কৃষি খাতে উন্নয়ন, পরিবেশ সুরক্ষা ও দুর্যোগ ঝুঁকিসহ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলাভিত্তিক কার্যক্রম।

কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোতালেব শরীফ বলেন, পায়রা সেতু চালু হয়েছে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর সারাদেশের পর্যটকরা পাঁচ থেকে ছয় ঘন্টার মধ্যে সাগরকন্যা কুয়াকাটায় পৌঁছতে পারবেন। ফলে মানুষ ১০ থেকে ১২ ঘন্টা সময় ব্যয় করে কক্সবাজার না গিয়ে স্বল্প সময়ে কুয়াকাটায় আসতে উৎসাহিত হবেন। পর্যটন এলাকায় বিনিয়োগকারীরা তাদের ব্যবসার প্রসার ঘটাবেন। ফলে একদিকে যেমন কর্মসংস্থানের পথ সৃষ্টি হবে, তেমনি অন্যদিকে ব্যবসার প্রসার ঘটবে। সবমিলিয়ে দক্ষিণাঞ্চল হবে পর্যটনকেন্দ্রীক বড় জোন।

বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার মোঃ আমিন-উল আহসান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতায় ইতোমধ্যে পায়রা সেতু চালু হওয়ায় বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে ফেরীবিহীন যোগাযোগ শুরু হয়েছে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটার সাথে ঢাকাসহ সারাদেশের ফেরীবিহীন যোগাযোগ শুরু হবে। দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগের ক্ষেত্রে শুরু হবে নতুন অধ্যায়। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রসার ঘটবে।

তিনি আরো বলেন, কুয়াকাটা ও পায়রা বন্দরকে ঘিরে ইতোমধ্যে দেশের বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকরা বিভিন্ন এলাকায় বিনিয়োগ করার জন্য জমি ক্রয় করছেন। আবার কেউ কেউ জমি ক্রয়ের জন্য উঠেপরে লেগেছেন। এখানে স্থাপিত হবে ইপিজেড। গোটা দক্ষিণাঞ্চলেকে ঘিরে বিভিন্ন ধরনের ভারী শিল্প-কলকারখানা স্থাপনের চিন্তা করছেন ব্যবসায়ীরা। এসব কারণে লাখ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। কুয়াকাটায় বহু কোম্পানী জমি ক্রয় করে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। উন্নয়নের ফলে অন্যান্য শিল্পমালিকরা উৎসাহিত হয়ে দক্ষিণাঞ্চলে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবেন বলে আমার বিশ্বাস। সবকিছু মিলিয়ে ভবিষ্যতে দক্ষিণাঞ্চল হবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু। দেশের অর্থনীতি সচলে গোটা দক্ষিণাঞ্চল বড় ভূমিকা রাখবে বলেও তিনি (বিভাগীয় কমিশনার) আশা প্রকাশ করেছেন।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বহুমুখী পদ্মা সেতুকে ঘিরে বিভাগীয় ট্রানজিট পয়েন্ট বরিশালকে আধুনিকরণে বেশ কয়েকটি মেগাপ্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। বিশেষ করে বরিশাল থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত মহাসড়ক ছয় লেনকরণের পাশাপাশি ট্রেনলাইন নির্মাণের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। অবশ্য এ প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রাথমিকভাবে সরকারের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট দপ্তরসমূহ উদ্যোগ নেয় এবং সড়ক ও রেললাইনের জমিও অধিগ্রহণের কাজ শুরু করে। কিন্তু পরবর্তীতে এসব প্রকল্প আর আলোর মুখ দেখেনি। ফলে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর বরিশালে যানবাহনের চাঁপ বৃদ্ধি পাবে এবং ভোগান্তি বাড়বে। এমন ভাবনায় সার্বিক পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করাসহ স্থানীয় ট্রাফিক বিভাগকে আগাম বেশকিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

বরিশাল বিভাগীয় প্রশাসনের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতুতে যান চলাচলের আগেই বরিশাল শহরের ১২ কিলোমিটার সড়ক প্রশ্বস্তকরণে সড়ক ও জনপথ বিভাগকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিভাগীয় শহর বরিশালকে যানজটমুক্ত রাখতে নগরীর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল নথুল্লাবাদ থেকে সরিয়ে অন্যত্র নিতে সিটি কর্পোরশনকে প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ বিভাগীয় প্রশাসনের এ প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে দ্রুতসময়ের মধ্যে বাস টার্মিনালকে কাশিপুরে নির্মিত ট্রাকস্ট্যান্ডে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

বিভাগীয় প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা বলেন, পদ্মা সেতুর উদ্বোধন আয়োজন নিয়ে বরিশালবাসীর মধ্যে যেমন আনন্দ-উল্লাস কাজ করছে, তেমনি পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেওয়া নিয়ে প্রশাসনের মধ্যে অস্তিরতা দেখা দিয়েছে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পকে ঘিরে সরকার সড়ক এবং রেললাইনসহ বরিশালে আধুনিকরণে যে উদ্যোগ গ্রহণ করছিলো তা বাস্তবায়ন হলে এখন এতোটা দুশ্চিন্তায় পরতে হতোনা। তারপরেও পদ্মা সেতু চালু পরবর্তী বরিশালকে কীভাবে যানজটমুক্ত এবং নিরাপদ রাখা যায় সে লক্ষ্যে প্রশাসন কাজ করে যাচ্ছে।

বরিশাল চেম্বার অব কমার্স ইন্ড্রাস্টির সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের সময় যতো ঘনিয়ে আসছে, বরিশাল তথা গোটা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের মাঝে আনন্দ-উচ্ছ্বাস ততোটাই বাড়ছে। ইতোমধ্যে সর্বস্তরে শুরু হয়েছে, ক্ষণগণনা। কিন্তু দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর বরিশালে অতিরিক্ত যানবাহনের চাঁপ বৃদ্ধি পাবে এবং এতে মানুষের দুভোর্গও বাড়বে। বিশেষ করে ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে বরিশাল পর্যন্ত সরু সড়ক সবকিছু তালগোল পাকিয়ে দিতে পারে। এ বিষয়টি নিয়ে ব্যবসায়ীদের বেশিমাত্রায় ভাবিয়ে তুলছে।

উল্লেখ্য, স্বপ্নের পদ্মা সেতু আগামী ২৫ জুন যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে। এদিন সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করবেন।

এর আগে গত মঙ্গলবার (১৭ মে) পদ্মা বহুমুখী সেতুর জন্য অনুমোদিত যানবাহনের শ্রেণী ও টোল হার নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সেতু বিভাগ।

প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, মোটরসাইকেলের টোল ১০০ টাকা, কার ও জিপ ৭৫০ টাকা, পিকআপ এক হাজার ২০০ টাকা, মাইক্রোবাস এক হাজার ৩০০ টাকা।

ছোট বাস (৩১ আসন বা এর কম) এক হাজার ৪০০ টাকা, মাঝারি বাস (৩২ আসন বা এর বেশি) দুই হাজার টাকা এবং বড় বাস (৩ এক্সেল) দুই হাজার ৪০০ টাকা।

ছোট ট্রাক (৫ টন পর্যন্ত) এক হাজার ৬০০ টাকা, মাঝারি ট্রাক (৫ টনের অধিক থেকে ৮ টন পর্যন্ত) দুই হাজার ১০০ টাকা, মাঝারি ট্রাক (৮ টনের অধিক থেকে ১১ টন পর্যন্ত) দুই হাজার ৮০০ টাকা, ট্রাক (৩ এক্সেল পর্যন্ত) পাঁচ হাজার ৫০০ টাকা, ট্রেইলার (৪ এক্সেল পর্যন্ত) ছয় হাজার টাকা।

প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, এ আদেশ পদ্মা বহুমুখী সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হওয়ার দিন থেকে কার্যকর হবে।

সেতু বিভাগের নির্ধারণ করা টোলের হার অনুসারে, বর্তমানে ফেরিতে পদ্মা নদী পার হতে যে টাকা লাগে, সেতু পার হতে এর চেয়ে গড়ে দেড় গুণ বেশি টাকা খরচ করতে হবে। আর দ্বিতীয় দীর্ঘতম বঙ্গবন্ধু সেতুর টোলের সঙ্গে তুলনা করলে তা হবে প্রায় দ্বিগুণ।

গত ২৮ এপ্রিল পদ্মা সেতুর জন্য টোল হার প্রস্তাব করে অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠায় সেতু মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের অনুমোদনের পর আজ তা প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করা হয়।

সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, সেতুটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের জন্য ম্যুরাল ও ফলক নির্মাণের কাজ চলছে। মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে ৪০ ফুট উচ্চতার দুটি ম্যুরাল নির্মিত হচ্ছে। দুটি ম্যুরালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিকৃতি থাকবে। জুনে সেতুতে যান চলাচল উদ্বোধনের লক্ষ্য নিয়ে দিনরাত কাজ চলছে বলে প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, সেতুতে এখন যেসব টুকিটাকি কাজ আছে, তা আগামী জুনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের কর্মপরিকল্পনা অনুসারে, আগামী ৩০ জুনের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ করার কথা ঠিকাদারের। এর মধ্যে সেতু চালু হবে ধরে নিয়ে টোল আদায়কারী ও সেতুর রক্ষণাবেক্ষণে ঠিকাদার নিয়োগ করেছে সেতু বিভাগ। এই কাজ পেয়েছে কোরিয়া এক্সপ্রেস করপোরেশন (কেইসি) ও চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি)। এর মধ্যে এমবিইসি বর্তমানে মূল সেতু নির্মাণকাজ এবং কেইসি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। আগামী পাঁচ বছরের জন্য এই দুটি প্রতিষ্ঠান টোল আদায়, সেতু ও সেতুর দুই প্রান্তে যানবাহন চলাচল ব্যবস্থাপনায় আধুনিক পদ্ধতি চালু এবং সেতু ও নদীশাসনের কাজ রক্ষণাবেক্ষণ করবে। এর জন্য পাঁচ বছরে তাদের দিতে হবে ৬৯৩ কোটি টাকা।

সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, টোল আদায়ের প্রস্তুতি নিতে এ মাসের শুরুর দিকে কেইসি ও এমবিইসিকে চিঠি দিয়েছে সেতু বিভাগ। সরকারি সংস্থাটি বলেছে, ৩০ জুনের মধ্যে পদ্মা সেতু চালু করার সিদ্ধান্ত রয়েছে সরকারের। ১ জুলাই থেকে টোল আদায় শুরু হতে পারে। সেভাবেই তাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। এই চিঠি পেয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টোল আদায়সংক্রান্ত সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার কিনতে দক্ষিণ কোরিয়ার বিভিন্ন কোম্পানিকে ইতিমধ্যে ফরমাশ দিয়েছে।

পদ্মা সেতুর (মূল সেতু) দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। দুই প্রান্তের উড়ালপথ (ভায়াডাক্ট) ৩ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে সেতুর দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার। পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। সেতু চালুর আগে প্রকল্প প্রস্তাব আবার সংশোধন করা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন। তবে সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ব্যয় বাড়বে কি না এবং বাড়লে কত বাড়তে পারে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।

এদিকে, পূর্ণাঙ্গ রূপ পেয়েছে পদ্মা সেতুর সড়কপথ। মূল সেতুর পর দুই প্রান্তের ভায়াডাক্টের কার্পেটিংও শেষ হয়েছে। এখন চলছে রেলিং ও রেলিংপোস্ট এবং দুই পাড়ে অস্থায়ী সাবস্টেশনে বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ।

জাজিরা প্রান্তের সাউথ ভায়াডাক্টে সোমবার (২৩ মে) বিকেলে কার্পেটিং সম্পন্ন হওয়ার মধ্য দিয়ে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর সড়ক পথ পেয়েছে পূর্ণাঙ্গতা। মূল সেতুর পর এখন সংযোগ সেতুর কার্পেটিংও শেষ।

পুরো সেতুজুড়েই এখন ব্ল্যাকটপ। আর রাতে আলো ছড়াতে দুই পাশের প্যারাপেটের নির্দিষ্ট দূরত্বে দাঁড়িয়ে ল্যাম্পপোস্ট। চলছে বিমানে আসা প্রথম ও দ্বিতীয় চালানের রেলিং ও রেলিংপোস্ট স্থাপন।

অন্যদিকে সমুদ্র পথে আসা রেলিংয়ের বড় চালানটি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে প্রকল্প এলাকায় নিয়ে আসার প্রক্রিয়া চলছে। সেতুতে রোড মার্কিং চলছে পুরোদমে। দুই পারে নাম ফলক ও ম্যুরালের কাজ শেষের দিকে এখন।

মূল পদ্মা সেতুর কাজের অগ্রগতি ছাড়িয়েছে ৯৮ শতাংশ। সার্বিক অগ্রগতি সাড়ে ৯৩ শতাংশের বেশি।

পদ্মা সেতু দেশের পদ্মা নদীর ওপর নির্মাণাধীন একটি বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু। এর মাধ্যমে মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ের সঙ্গে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর যুক্ত হবে। ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব অংশের সংযোগ ঘটবে।

দুই স্তরবিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাস ব্রিজটির ওপরের স্তরে থাকবে চার লেনের সড়ক পথ এবং নিচের স্তরটিতে একটি একক রেলপথ। পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর অববাহিকায় ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ৪১টি স্প্যান ইতোমধ্যে বসানো হয়েছে, ৬.১৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৮.১০ মিটার প্রস্থ পরিকল্পনায় নির্মিত হচ্ছে দেশটির সবচেয়ে বড় সেতু। পদ্মা সেতু নির্মাণকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি।

খরস্রোতা পদ্মা নদীর ওপর ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ হচ্ছে স্বপ্নের এ সেতু। ২০১৪ সালে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়।