মার্কেট ভাড়ার টাকা যায় এমপির একাউন্টে

Posted on August 21, 2023

আতিকুর রহমান, ঝিনাইদহ প্রতিনিধিঃ ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে সরকারি নলডাঙ্গা ভূষণ পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জায়গায় নির্মিত ২০টি দোকান ভাড়ার টাকা স্থানীয় এমপির ব্যাংক এ্যাকাউন্টে যাচ্ছে। এ কথা এমপি নিজেও স্বীকার করেছেন। সরকারী স্কুলের জায়গায় নির্মিত মার্কেটের বৈধতা ও ভাড়ার টাকা নিয়ে নয়ছয় করায় কালীগঞ্জ শহরের হৈচৈ পড়ে গেছে। এ ঘটনাটিকে অনেকেই দুরভিসন্দি বলে মনে করছেন। সরকারি প্রতিষ্ঠানের জমিতে মার্কেট ছাড়াও গড়ে উঠেছে দলীয় কার্যালয়। আর এভাবেই বছরের পর বছর কালীগঞ্জ ক্রীড়া ফেডারেশনের নামে দোকান ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। নতুন করে দোকানের ভাড়া চুক্তি ও অগ্রীম টাকা আদায় করতে গিয়ে ভাড়ার টাকা নয়ছয় করার বিষয়টি জানাজানি হয়ে পড়েছে। জানা গেছে, ২০১৬ সালের ২৫ ফেব্রæয়ারি জাতীয়করণ করা হয় নলডাঙ্গা ভ‚ষণ পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়। জাতীয়করণের আগে

স্কুলটির ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ছিলেন ঝিনাইদহ-৪ (কালীগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার। ২০১৫ সালে ম্যানেজিং কমিটির সভায় দোকান ভাড়ার টাকা কালীগঞ্জ ক্রীড়া ফেডারেশনের অধীনে জমা নেওয়া হবে বলে রেজুলেশন করা হয়। ওই সভায় এমপির অনৈতিক প্রস্তাবের বিরোধীতা তখন কেউ করেননি। এরপর থেকে সরকারি স্কুলের জায়গায় গড়ে ওঠে বহুতল বিশিষ্ট মার্কেট। ২০টি দোকান থেকে ক্রীড়া ফেডারেশনের নামে ভাড়া উঠানো হয়। আর এই ক্রীড়া ফেডারেশনের সভাপতি এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার নিজেই। এদিকে প্রতিমাসে দোকান প্রতি ৪০০ টাকা করে স্কুলকে প্রদান করার কথা থাকলেও এ পর্যন্ত মাত্র এক লাখ দেওয়া হয়েছে। গত ৮ বছরে স্কুল ফান্ডে প্রায় ৭ লাখ ৬৮ হাজার টাকা জমা হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। সব টাকা লুটপাট করার উদ্দেশ্যে ব্যক্তি বিশেষের একাউন্টে জমা করা হচ্ছে। সরজমিন দেখা গেছে, ছোট-বড় এসব দোকানের ভাড়া ২ হাজার থেকে শুরু করে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়। মুদির দোকানী ব্রজলাল কুমার জানান, তিনি প্রতি মাসে ২৭০০ টাকা করে ভাড়া দেন। আবার নতুন করে ভাড়াচুক্তি ও অগ্রিম টাকা দিতে হচ্ছে বলে ব্রজলাল জানান।

তিনি আরো জানান, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার এ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের একটি হিসাব নম্বরে (০০৭৯১১১০০০০১১) ভাড়া ও চুক্তিমূল্য পরিশোধ করছে ব্যবসায়ীরা। ব্যাংক সুত্রে জানা গেছে, এই হিসাব নম্বরটির সত্তাধীকারী অরিন এন্টার প্রাইজ। অরিন এন্টার প্রাইজ ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় অরিন এন্টার প্রাইজ নামে তার একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে বলে উল্লেখ করেছেন। মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, সরকারী বিদ্যালয়ের জমিতে ৪টি ভবনে ছোট-বড় ২০টি দোকান রয়েছে। একটি ভবনের ২য় ও ৩য় তলায় আওয়ামীলীগের দলীয় কার্যালয় রয়েছে। স্কুলের পক্ষ থেকে সেখানে একতলা ভবন তৈরি করা হয়েছিল। এরপর ওই ভবনের ২য় ও ৩য় তলা নির্মাণ করে এমপি নিজেই। স্কুলের জমিতে গড়ে ওঠা অন্য একটি ভবনে দুই তলা নির্মাণ করে কালীগঞ্জ ভ‚ষিমাল ব্যবসায়ী সমিতি নামে একটি কার্যালয় ভাড়া দেওয়া হয়েছে। আর এই দুইটি ভবন নির্মানে স্কুল কর্তৃপক্ষের সাথে কোন প্রকার আলোচনা বা চুক্তি হয়নি বলে জানান সরকারি নলডাঙ্গা ভ‚ষণ পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মকবুল হোসেন তোতা।

তিনি জানান, স্কুল জাতীয়করণ হওয়ার আগে আনোয়ারুল আজীম আনার এমপি ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ছিলেন। ২০১৫ সালে ম্যানেজিং কমিটির সভায় রেজুলেশন করে বিদ্যালয়ের জমিতে স্থাপিত ৪টি ভবনের ছোট-বড় ২০ টি দোকান কালীগঞ্জ ক্রীড়া ফেডারেশনের নামে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। প্রতিমাসে দোকান প্রতি ৪০০ টাকা স্কুলকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত মাত্র এক লাখ টাকা চেকের মাধ্যমে দিয়েছে ক্রীড়া ফেডারেশন। ২০২২ সালের ২৯ মে এই টাকা জমা দেয়। প্রধান শিক্ষক মকবুল হোসেন তোতা আরো জানান, স্কুল কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়েই ভবন নির্মাণ করে দলীয় কার্যালয় বানানো হয়েছে। এদিকে দোকান ভাড়া প্রদানের রশিদ ও নতুন করে চুক্তি বাবদ অগ্রীম টাকা প্রদানের একটি চিঠি সম্প্রতি ফাঁস হয়ে পড়েছে। গত ৩১ জুলাই কালীগঞ্জ ক্রীড়া ফেডারেশনের নামে এই চিঠি দোকান মালিকদের কাছে পাঠানো হয়। তবে ওই সাদা কাগজে কারও স্বাক্ষর নেই। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, “কালীগঞ্জ ক্রীড়া ফেডারেশনের একটি ঘর আপনাকে ভাড়া প্রদান করা হয়েছে। আগামী ১০ আগস্টের মধ্যে অগ্রীম এক লাখ টাকা ও বকেয়া দুই মাসের ভাড়ার টাকা পরিশোধ না করলে ১৫ আগস্টের মধ্যে বরাদ্দকৃত ঘর বাতিল বলে গন্য হইবে”। এছাড়াও চিঠিতে ব্যাংকের একটি হিসাব নম্বর দেওয়া ছিল।

বেশির ভাগ দোকান মালিকদের অভিযোগ, সময় না দিয়ে তড়িঘড়ি করে নতুন করে চুক্তি করা হচ্ছে। জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে টাকার অংক। ইচ্ছামতো বাড়ানো হয়েছে দোকানের ভাড়া। স্থানীয় এমপির বাড়ির সামনে মার্কেটটি হওয়ায় ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পারছেন বলে নাম প্রকাশে অচ্ছিুক একাধিক দোকান মালিক জানান। ব্যবসায়ীরা জানান, জনৈক অজিৎ ভট্টাচার্য ও এমপির একান্ত সহকারী আব্দুর রউফ দেখাশোনার পাশাপাশি ভাড়ার টাকা আদায় করছেন। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার বলেন, সরকারী করণের আগেই ক্রীড়া ফেডারেশনের সঙ্গে স্কুলের ৯৯ বছরের চুক্তি হয়। সেই মোতাবেক ভাড়ার একটি অংশ স্কুল পায় আর বাকী অংশ ক্রীড়া ফেডারেশন পায়।

তিনি বলেন ফেডারেশনের সেক্রেটারি ইন্তেকাল করায় ভাড়ার টাকা একাউন্টে রাখতে অসুবিধা হচ্ছে। এ কারণে তার একাউন্টে টাকা সাময়িকের জন্য রাখা হচ্ছে। নতুন একাউন্ট খুললে টাকা সেই একাউন্টে চলে যাবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন ফেডারেশনের মিটিং না হওবার কারণে স্কুলের ভাড়ার অংশ দেয়া যাচ্ছে না। অচিরেই স্কুলের ভাড়ার টাকা প্রদান করা হবে। বিদ্যালয়টির সভাপতি ও কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইশরাত জাহান বলেন, সরকারি স্কুলের দোকান ভাড়া সম্পর্কে তিনি মোটেও অবগত নন। স্কুলটি সরকারী হলেও তারা তাদের নিয়ম মাফিক চলেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। ঝিনাইদহ জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার শেখ মনিরুল ইসলাম বলেন, অনুমিত বা সরকারী নির্দেশনা ছাড়া সরকারী হাই স্কুলের জায়গায় দোকান বা অন্য স্থাপনা তৈরী করা বেআইনী।

সরকারীকরণের আগেই যদি এই মার্কেট করা হয়, তবে সরকারীকরণের পর ভাড়ার টাকা অবশ্যই সরকারী কোষাগারা জমা হবে। কারো ব্যক্তিগত একাউন্টে ভাড়ার টাকা জমা হওয়া অবৈধ ও দুর্নীতির সামিল। তিনি বলেন, বিষয়টি মন্ত্রনালয়ের আইন শাখাকে জানিয়ে করণীয় ও প্রতিকার চাওয়া হবে।