সিরাজগঞ্জে বীজ উৎপাদনে সফল কিষানি মরিয়ম খাতুন

Posted on July 26, 2023

সেলিম রেজা, সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি: সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার জালালপুর ইউনিয়নের যমুনা নদী তীরবর্তী একটি গ্রামের নাম সৈয়দপুর। এ গ্রামেরই মেয়ে মরিয়ম খাতুন। বেড়ে উঠেছিলেন কৃষিপ্রধান পরিবারে।

পরবর্তীতে একই গ্রামের রবিউল ইসলামের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। বিয়ের পর অন্য আর দশটা সাধারণ নারীর মতোই সংসারে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। বিয়ের পর অভাবের সংসারে পড়ে সচ্ছলতার সঙ্গে দেখা মেলেনি বহুদিন। রবিউল-মরিয়ম দম্পতি নিজেদের জমি চাষ করতেন। পাশাপাশি অন্যের জমিও বর্গা নিতেন। তবে সারা বছর কঠোর পরিশ্রম করা সত্ত্বেও লাভের মুখ দেখতেন না তারা। এমতাবস্থায় উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে প্রশিক্ষণ নিতে যান তারা। সেখানে আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা পায় এ কৃষক দম্পতি। কিন্তু রবিউল এ নতুন প্রযুক্তি মানতে নারাজ। অন্যদিকে শিক্ষিত মরিয়ম এ প্রযুক্তি লুফে নেন। তিনি বুঝতে পারেন তার কৃষিকাজকে সহজ করতেই এ প্রযুক্তির আবির্ভাব। শুরু হয় কিষানি মরিয়মের নতুন পথে যাত্রা। বরের নারাজির মুখেও নিজের অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া ছেলেকে নিয়ে কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শে শুরু করেন চাষাবাদ।

ফসল ফলাতে গেলে এক অপরিহার্য নাম বীজ। ভালো বীজই পারে ফসলের বাম্পার ফলন এনে দিতে। অন্যদিকে মানহীন বীজ কৃষকের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা শ্রমকে পণ্ডশ্রমে পরিণত করে। একই সঙ্গে গচ্চা যায় কৃষকের সময় ও অর্থ'। যে অর্থের চাকায় ঘোরে কৃষকের ভাগ্য। ফলে ভালো বীজ কৃষকের কাছে রত্নসম। মরিয়মকে আগ্রহী দেখে স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচেন। কারণ কৃষককে নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত করানো এক কঠিন বিষয়। বেশিরভাগ কৃষকই নতুন প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহী হন না।
অবশ্য কৃষি অধিদফতরের কাছে এ চিত্র নতুন নয়। নতুনকে মেনে নেওয়া সবসময়ই কষ্টসাধ্য কাজ। কৃষি সম্প্রসারণের অধিদফতরের পরামর্শে প্রথমবারের মতো ৬ বিঘা জমির ওপরে বারি সরিষা-১৪, ৬ বিঘা জমির ওপর বারি তিল-৪-এর বীজ উৎপাদন করেন মরিয়ম। এতে উৎপাদন ও বীজ সংরক্ষণে খরচ হয় ১ লাখ ৮ হাজার টাকা এবং এ বীজ বিক্রি হয় ২ লাখ ২৮ হাজার টাকায়। এতে প্রথম বছরেই ১ লাখ ২০ হাজার টাকা লাভের মুখ দেখে মরিয়ম। তারপর থেকে তাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি।

গত ৪ বছর ধরে বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ করে ফি বছর লাখ টাকা আয় করেন মরিয়ম।, এ ছাড়াও সিরাজগঞ্জের গণ্ডি পেরিয়ে সারা দেশে তার উৎপাদিত বীজ পৌঁছে যাচ্ছে এখন কৃষকের হাতে। বীজ উৎপাদন করে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে অনেক চাষির কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছেন তিনি। কেবল বীজ উৎপাদন করেই যে স্বাবলম্বী হওয়া সম্ভব তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মরিয়ম। গত ৪ বছর ধরে তার উৎপাদিত উৎকৃষ্ট মানের ‘রবি সিড’ বীজ এখন দেশজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে'। এ সফলতার জন্য একাধিক বার পেয়েছেন সরকারি সম্মাননা।

নিজের উৎপাদিত রবি সিড কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে প্রথমে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কৃষক পর্যায়ে উন্নতমানের ডাল, তেল ও মসলা বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ প্রকল্পের আওতায় বারি সরিষা-১৪,খেসারি ও তিলের বীজ উৎপাদন প্রদর্শনী দেওয়া হয় মরিয়মকে। পরের বছর পেঁয়াজ বীজ উৎপাদন প্রদর্শনী পান। সেখানে বীজ উৎপাদন করে লাভবান হন মরিয়ম। সেই থেকে তার বীজ ব্যবসার হাতেখড়ি। সেই ধারাবাহিকতায় ব্যাপক উৎসাহ নিয়েই নিয়মিত বারি সরিষা-১৪ ও ১৭, তাহেরপুরি পেঁয়াজ বীজ, খেসারি, মসুর, তিল ও ধানের বীজ উৎপাদন করছেন।

এখন প্রায় সারা দেশেই ‘রবি সিড’ বীজ পৌঁছে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভালো মানের বীজ উৎপাদনে আমি সফল হয়েছি। বীজ উৎপাদনে প্রায় আড়াই থেকে ৩ লাখ টাকা উৎপাদন ব্যয় হলেও উৎপাদিত বীজ ৬ থেকে সাড়ে ৬ লাখ টাকা বিক্রি হওয়ায় প্রতি বছর প্রায় ৩ লাখ টাকা লাভ হয়।

শাহজাদপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাকৃষিবিদ জেরিন আহমেদ বলেন, কিষানি মরিয়ম কৃষি বিভাগের সহায়তায় ও নিজের অদম্য পরিশ্রমে উপজেলায় নারী বীজ উদ্যোক্তাদের একজন রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন'। ভবিষ্যতেও তার সাফল্য ধরে রাখার জন্য উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে সব ধরনের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করা হবে।