মীর নাজিম উদ্দিন আহমেদ : আমাদের ছোট বেলায় সকলেই আদর্শ লিপিতে এই শ্লোকগুলো পড়ে বড় হয়েছি:
“সদা সত্য কথা বলিবে”
“সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস”
“অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ”
আজ বাস্তব জীবনে এসে এর প্রয়োগ কতটা বাস্তবিক তা সকলের কাছে সহজেই অনুমেয়। প্রাত্যহিক জীবনে যেমন ধনী গরীবের পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় তেমনি, বীমার জগতেও বড় এবং ছোট কোম্পানীগুলোর পার্থক্য সহজেই নজরে পড়ে।
যে সকল কোম্পানীর আর্থিক অবস্থা যতবেশী শক্তিশালী সে সকল কোম্পানীর দাবী প্রদানের সক্ষমতাও ততবেশী এবং অর্থের অপব্যবহারও সে সকল কোম্পানীতেই বেশী দেখা যায়। অর্থের অপচয়ের কারণেই কোন কোন কোম্পানী দাবী নিষ্পত্তি করতে গড়িমসি করে। এতে করে বীমা গ্রহীতা যেভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় ঠিক তেমনিভাবে পুরো বীমা সেক্টরের দুর্নামও ছড়ায়।
লাইফ বীমা কোম্পানীগুলো সাধারণতঃ ১২, ১৫, ১৮, ২১, ২৪ বৎসর মেয়াদী পলিসি করে থাকে। এই পলিসিগুলো থেকে যথানিয়মে প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে এবং তা বিভিন্ন ব্যাংকে চড়া সুদে/প্রফিটে বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রচুর মুনাফা অর্জন করে থাকে। ফলে কোম্পানীগুলো অর্জিত মুনাফা থেকে পলিসি হোল্ডারদের প্রতি বৎসর পলিসির ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন হারে বোনাস দিয়ে থাকে।
কোন পলিসি ম্যাচিয়ুর হলে, পলিসি হোল্ডার মারা গেলে, হাসপাতালে চিকিৎসা নিলে, টার্ম পলিসির ক্ষেত্রে টার্ম শেষ হয়ে গেলে পলিসি হোল্ডারদেরকে পলিসির শর্তানুযায়ী মেয়াদান্তে একসাথে অনেক টাকা প্রদান করতে হয়। অপরদিকে অগ্নি, বন্যা, ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুযোর্গেও গাড়ী দুর্ঘটনায় নন-লাইফ বীমায় প্রচুর পরিমানে দাবী পরিশোধ করার প্রয়োজন হয়। এই সময়টাই কোম্পানীর প্রকৃত আর্থিক অবস্থান বুঝা যায়।
বীমা ব্যবসায় আর্থিক ব্যবস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পলিসি হোল্ডারদের থেকে সংগ্রহকৃত অর্থ সঠিকভাবে বিনিয়োগ না করতে পারলে অথবা সংগৃহীত টাকা উপার্জনমুখী কাজে ব্যবহার করতে না পারলে, মেয়াদান্তে নির্দিষ্ট সময়ে পলিসি হোল্ডারদের তাদের বোনাসসহ অর্থ ফেরৎ দিতে বীমা কোম্পানীকে বেগ পেতে হয়। যা আমরা সচরাচর প্রত্যক্ষ করছি। এই জন্য বহু লাইফ কোম্পানীতে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে প্রশাসক নিয়োগ করতে হয়েছে। আবার নন-লাইফ বীমায় বহু মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাকে চাকুরীচ্যুত হতে হয়েছে।
আবার এটাও দেখা যায় বীমা কোম্পানীগুলো লাভ করতে না পারলেও বৎসর বৎসর শেয়ার হোল্ডারদের জন্য লভ্যাংশ ঘোষণা করে এবং তা প্রদানও করে থাকে। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে তার লাইফ ফান্ড, বা পলিসির বিপরীতে বীমা আইন অনুযায়ী যে রিজার্ভ থাকার কথা তা যথার্থ পরিমানে নেই। সে ক্ষেত্রে লভ্যাংশ ঘোষণা ও পলিসির বোনাস ডিকলেয়ার ও প্রদান এক বিতর্কের সৃষ্টি করে। অনেক সময় একচ্যুয়ারীগণও মালিক পক্ষকে সন্তষ্ট রাখার জন্য তাদের মন মতো রিপোর্ট দাখিল করে থাকেন। যা নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য নহে।
বীমা শিল্পে কোন দুর্ঘটনা বা দূর অতীতের অভিজ্ঞতা এবং ভবিষ্যতে ঘটতে পারে এমন তাত্ত্বিক ধারনার উপর ভিত্তি করে পলিসির প্রিমিয়াম ও টার্মস্ ঠিক করা হয়। যা ঘটতে পারে বা নাও পারে বা ধারনার অধিকও ঘটতে পারে। বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি এবং মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির কারণে মৃত্যুর হার অনেক কমেছে। মানুষ নিজেকে সুস্থ্য রাখার জন্য খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রেও সচেতন হয়েছে এবং চিকিৎসকের পরামর্শের জন্যে ছুটে চলেছে। যার ফলে হসপিটালাজেশন বীমার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। যা লাইফ বীমা শিল্পে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। পাশাপাশি ব্যবসা আহরণে কোম্পানীগুলোর মধ্যে অনৈতিক প্রতিযোগীতাও শুরু হয়েছে। শুধু তাই নয় নন-লাইফ বীমায় কমিশন বাণিজ্যও সমান তালে ছুটে চলেছে যা কোম্পানীর আর্থিক খাতকে দুর্বল করছে। এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কিছু কিছু উন্নয়ন কর্মকর্তার সহযোগীতায় গাড়ীর শো-রুমগুলো বিভিন্ন কোম্পানীর কাগজ তৈরী করে বীমা গ্রহীতাদের সরবরাহ করছে যা নন-লাইফ বীমার ভাবমূর্তির ক্ষেত্রে বিরাট হুমকিস্বরূপ। দুর্ঘটনা ঘটার পর বীমা গ্রহীতা জানতে পারেন যে, তাঁর গাড়ীটি কোন বীমা কোম্পানী থেকে বীমা করা হয়নি।
গ্রুপ বীমা একটি জনপ্রিয় বীমা। কোন প্রতিষ্ঠানের সকল কর্মকর্তা কর্মচারী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের এই বীমার আওতায় আনা যায়। তাই এই লাভজনক ব্যবসা করায়ত্ত করতে সকল কোম্পানীই কম প্রিমিয়াম রেট ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দিয়ে ব্যবসা সংগ্রহে প্র্রবল প্রতিযোগীতার সম্মুখীন হয়। ফলে বীমা কোম্পানী ব্যবসা আহরণে যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হয় তেমনি পলিসি হোল্ডারগণও বিভিন্ন শর্তাদির কারণে তাদের ন্যায্য সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। নন-লাইফ বীমায় কর্মরত কর্মীদের জন্য জনপ্রিয় এই বীমা প্রকল্পটি অনেকাংশেই চালু করা সম্ভব হয়নি। যা জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে বড় বাঁধা।
লাইফ বীমা পুরোপুরি এজেন্ট নির্ভর ব্যবসা। এজেন্টদের ব্যবসা আহরণে ঝোঁকের মতো বীমা গ্রহীতাদের সাথে লেগে থাকতে হয়। তাদের প্রচুর ট্রেনিং-এর প্রয়োজন হয়। লাইফ ব্যবসা সংগ্রহে এজেন্টদের তার কোম্পানীর সকল পলিসির নিয়ম-কানুন ভাল করে জেনে তবেই বীমা গ্রহীতা বা পলিসি হোল্ডারের নিকট যেতে হয়। যদিও প্রতিটি কোম্পানীই তাদের পলিসিগুলোর জন্য শর্ট লিফলেট, ব্রোসিয়ার, প্রিমিয়াম হার, টার্মস-কন্ডিশনের জন্য বুকলেট তৈরী করে থাকে। যা এজেন্টদের ব্যবসা সংগ্রহের কাজে লাগে। তবুও তাদের জ্ঞানের পরিধিকে শানিত করার লক্ষ্যে ট্রেনিং-এর বিকল্প নেই। অপরদিকে নন-লাইফ বীমা উন্নয়ন কর্মী নির্ভর এবং সরকারী বিধি বিধানের কারণে বাধ্যতামূলকভাবে বীমা করতে হয় বলে এজেন্ট তৈরী হয়নি এবং বিভিন্ন রেফারেন্সে যেমন ব্যবসায়ী, ব্যাংকার ও অন্যান্য কারণে কর্মী নিয়োগের ফলে তাঁরা প্রশিক্ষিতও নহেন। তারা প্রশিক্ষণ নেয়া প্রয়োজন বলেও মনে করেন না। যা নন-লাইফ বীমার প্রচার ও প্রসারে বড় দুর্বলতা।
লাইফ বীমায় এজেন্টদের পারিশ্রমিক সম্বন্ধে সাধারণ পাবলিক অবহিত নহেন। তাই তাদের পারিশ্রমিক থেকে পলিসি হোল্ডারকে কিছুই দিতে হয় না। অপরদিকে নন-লাইফ বীমার কমিশন সম্পর্কে বীমা গ্রহীতা অবহিত থাকায় উন্নয়ন কর্মীদের কমিশনের পাশাপাশি তাদের বেতনের একটি বড় অংশ বীমা গ্রহীতাদের দিতে হয়। তাই মাস শেষে উন্নয়ন কর্মীদের প্রায় খালি হাতেই বাড়ী ফিরতে হয়। যা বীমা শিল্পের জন্য এক অশনি সংকেত। তাছাড়া ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তনও এই খাতে অস্থিরতার সৃষ্টি করেছে।
লাইফ বীমায় ক্ষুদ্র বীমা একটি বহুল আলোচিত বিষয়। যা বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছে। নন-লাইফ বীমার পিপলস্ পারসোনাল এক্সিডেন্টস পলিসির মতো। আমাদের গ্রামগঞ্জের কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর, রিক্সাচালক, গৃহস্থ নারীদের মধ্যে এর ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। লাইফ বীমা কোম্পানীগুলো শত শত কোটি টাকা সংগ্রহ করলেও তা বিভিন্ন কায়দায় কোম্পানীর হিসাবে জমা না হয়ে এজেন্টদের পকেটস্থ হচ্ছে যা কোম্পানীর ভাবমূর্তির সাথে বীমা শিল্পকেও ক্ষতিগ্রস্থ করছে।
লাইফ বীমা ব্যবসা যেহেতু এজেন্ট নির্ভর তাই তাদের মধ্যে যদি সততার অভাব ঘটে তবে পুরো বীমা শিল্পই ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এই বিষয়টি মাথায় রেখে এজেন্টদের মনিটরিং, উন্নত মানসিক ও সৎ চিন্তাশীল ব্যক্তি হিসাবে গড়ে তোলার দায়িত্ব সকলকে নিতে হবে। নন-লাইফ বীমা এজেন্ট না উন্নয়ন কর্মী দ্বারা পরিচালিত হবে তা সম্মিলিতভাবে সকল পক্ষকে এক মত হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া না গেলে এই শিল্পে শৃংখলা ফিরিয়ে আনা যাবে না।
করোনা মহামারীর কারণে পলিসি হোল্ডারদের সাথে সরাসরি দেখা করা যায় নাই বলে এজেন্টদের এবং উন্নয়ন কর্মীদের যতই প্রটেনশিয়ালিটি থাকুক না কেন তা প্রকাশ পায় নাই। কারণ ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে যতই আলোচনার কথা আমরা বলি না কেন তা স্বাভাবিক জীবন যাত্রার মধ্যে পড়ে না। আর এই কারণে এজেন্টদের এবং উন্নয়ন কর্মীদের পক্ষে নতুন নতুন পলিসি সংগ্রহ করা সম্ভব হয় নাই। এই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কোম্পানীগুলোর কর্মীদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া উচিৎ। দীর্ঘদিন বীমা কোম্পানীতে কাজ করেও এজেন্টরা বা উন্নয়ন কর্মীরা করোনাকালীন সময়ে বীমা কোম্পানী বা সরকার থেকে কোন অনুদান না পাওয়ার কারণে মানবেতর জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। যা নিবিড়ভাবে ভেবে দেখার সময় এসেছে। বীমাকর্মী বা এজেন্টকে পেশার প্রতি আগ্রহী করা না গেলে বীমা শিল্পকে নৈতিক অবস্থানে ফিরিয়ে আনা যাবে না।
আজ আমরা কোম্পানীগুলোর যে বিরাট বিরাট অট্টালিকা দেখি তা বীমাকর্মী বা এজেন্টদের ঘামেই অর্জিত হয়েছে। তাঁদের বঞ্চিত করে কোনভাবেই বীমা শিল্পকে টিকিয়ে রাখা যাবে না।
লেখকঃ মীর নাজিম উদ্দিন আহ্মেদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স কোঃ লিঃ।
© ২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | কর্পোরেট সংবাদ সম্পাদক - মোঃ মিজানুর রহমান । উপদেষ্টা সম্পাদক- জেসমিন আক্তার, এফসিএস ই-মেইলঃ corporatesangbad@gmail.com । ফোনঃ ০২২২-৩৩৫৪১২৫ । মোবাইলঃ ০১৭১১০৭৬৮১৫ অফিসঃ ৫৫/বি, নোয়াখালী টাওয়ার, ১১ তলা, সুইট ১১-এফ, পুরানা পল্টন, ঢাকা ১০০০ |
আর্থিক অনিয়ম করোনাকালীন বীমা শিল্পে প্রভাব https://corporatesangbad.com/388992/ |