অনিবন্ধিত নিউজ পোর্টালে বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয়, বন্ধ হওয়া জরুরি

Posted on November 10, 2021

সম্পাদকীয় : চলতি বছরের ৫ই মে সংবেদনশীল সংবাদসহ যে কোন খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে সংবাদ মাধ্যমগুলোর জন্য নৈতিক নীতিমালা চেয়ে সংশ্লিষ্টদের একটি আইনি নোটিশ পাঠায় হাইকোর্টের দুই আইনজীবী। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রনালয়ের সচিব, বিটিআরসি’র চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যানকে ঐ আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সে নোটিশের কোন জবাব না পেয়ে হাইকোর্টে রিট মামলা দায়ের করেছিলেন হাইকোর্টের আইনজীবী জারিন রহমান ও রাশিদা চৌধুরী নীলু।

রিট পিটিশনে তাদের আবেদন ছিল রাজধানীতে ২১ বছর বয়সী একটি মেয়ের আত্মহত্যার প্ররোচণার অভিযোগে মামলা দায়ের করা। পরবর্তীতে ঐ ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে  অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোতে নানাভাবে নিউজ পরিবেশন করে। অথচ এসব সংবাদ পরিবেশনা বন্ধে বিটিআরসি  এবং বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।

পরবর্তীতে রিটের শুনানি শেষে ‘ন্যাশনাল অনলাইন মাস মিডিয়া পলিসি-২০১৭’ অনুযায়ী দেশে অননুমোদিত ও অনিবন্ধিত অনলাইন মিডিয়াগুলো কেন বন্ধ করা হবে না- তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট ডিভিশনের একটি বেঞ্চ।

পরবর্তীতে চলতি বছর সেপ্টেম্বরের ২য় সপ্তাহে ১৪/৯/২০২১ তারিখে রুলের উপর শুনানি শেষে ৭ দিনের মধ্যে সব অনিবন্ধিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মো. কামরুল হোসেন মোল্লা এর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দিয়েছিলেন। আর হাইকোর্টের আদেশ বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিয়েছিলেন বিটিআরসি চেয়ারম্যান ও প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যানকে। পরবর্তীতে আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়নে ২৮/৯/২০২১ তারিখে বিটিআরসি অনলাইন নিউজ পোর্টাল বন্ধের প্রক্রিয়া শুরু করে সন্ধ্যায় আবার তা স্থগিত রাখে।

এ প্রেক্ষিতে ২৯/৯/২০২১ তারিখে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার অনিবন্ধিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল বন্ধের বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেছিলেন যে, আমরা তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রনালয়ের কাছে অনিবন্ধিত নিউজ পোর্টালের তালিকা চেয়েছি। তাদের তালিকা অনুযায়ী অনিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল বন্ধ করা হবে। এই প্রেক্ষিতে আদালতের কাছে সময় চাওয়া হয়েছে বলেও মন্ত্রী জানান। ফলে অনিবন্ধিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল বন্ধে হাইকোর্টের আদেশ প্রতিপালনে আরও দুই সপ্তাহ সময় পায় বিটিআরসি। এতে পরবর্তী সুনানির জন্য ২৫/১০/২০২১ আদালতের দিন ধার্য থাকলেও এ বিষয়ে কোন সুরাহা হয়নি। ফলে পূর্বের ন্যায় বহাল তবিয়তে চালু রয়েছে দেশের সব অনিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল।

শুধুমাত্র ২১ বছর বয়সের ১টি মেয়ের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে দন্ডবিধির ৩০৬ ধারায় মামলা ও পরবর্তীতে অনলাইন নিউজ পোর্টালের বাড়াবাড়ি এবং অতিরঞ্জিত মুখরোচক ফেক নিউজ,  মানহানিকর তথ্য অনলাইন পত্রিকার বরাতে সোশ্যাল মিডিয়ায়ও ভাইরাল হয়েছে। এমনিভাবে চিত্রনায়িকা পরিমনিকে নিয়েও আন্ডারগ্রাউন্ড ও অনিবন্ধিত অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো নানাভাবে পাঠকের দৃষ্টি কাড়া বানোয়াট মানহানিকর ও মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করেছে যা সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখলেই বোঝা গেছে। অনিবন্ধিত নিউজ পোর্টালগুলো কতটা ভয়ংকর ও ভয়াবহ সংবাদ প্রকাশ করে সমাজের নানা স্তরে অবক্ষয় ঘটতে পারে তা আমাদের বুঝতে হবে।।

এমনিভাবে গ্রামে-গঞ্জে, শহরের আনাচে-কানাচে গড়ে ওঠা অনিবন্ধিত ঐসব নিউজ পোর্টালে হচ্ছে সামাজিক অবক্ষয়। ছোট ছোট তুচ্ছ ঘটনাকেও ফুলিয়ে ফাপিয়ে অনেক বড় করে বাদী-বিবাদি পক্ষের ফেক ভিডিও ধারণ করে একপক্ষ আরেক পক্ষকে হেয় প্রতিপন্ন করে ফেক নিউজ প্রকাশ করছে। যা পরবর্তীতে সোশ্যাল মিডিয়ায় হানিকর (ফেক নিউজ) প্রচার করে ভাইরাল করে সমাজের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মান সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল করা হয়েছে। যে কারণে শুধু আত্মহত্যা নয় আরও অনেক বড় বড় সামাজিক অবক্ষয়ের ঘটনা ঘটেছে এবং এখনও ঘটছে।

অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় অনিবন্ধিত অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নিয়ে নয়-ছয় বা ছোটছোট ঘটনাকে কেন্দ্র করে কতিপয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিজ্ঞাপনের নামে চাঁদাবাজি করছে। বিজ্ঞাপন বা চাঁদা না দিলেই তারা জিম্মি করে ফেলে প্রতিষ্ঠানের মালিক, পরিচালক ও কর্তা ব্যক্তিদের। নামে- বেনামে, করে দেয় ফেক নিউজ। ফলে মান সম্মানের ভয়ে তখন ঐ পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের নামে চাঁদা দিতে বাধ্য হন তারা। অফিস, স্টাফ, ঠিকানা, মালিক ও সম্পাদক নিবন্ধিত না হওয়ায় ভুক্ত ভোগীরা মামলা করেও কোন বিচার পাননা, ফলে বেড়েই চলেছে তাদের দৌরাত্ব।

একই ঘটনা ঘটেছে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রেও। কারণ এখানে বিএসইসি ও স্টক একচেঞ্জের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি তালিকাভূক্ত কোম্পানিকে প্রাইজ সেন্সিটিভ ইনফরমেশন (পিএসআই), ডিসক্লোজার, ফাইন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্ট প্রচারসহ এজিএম, ইজিএম, বোর্ড মিটিং সংক্রান্ত অনেক তথ্য অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোতে পাবলিশ করার বাধ্যবাধকতা থাকায় নামে বেনামে অনিবন্ধিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল খুলে তালিকাভুক্ত কোম্পানির এমডি, চেয়ারম্যান, সিএফও এবং সিএসদের ধমক দিয়ে মানহানিকর তথ্য প্রকাশের ভয় দেখিয়ে অনিবন্ধিত নিউজ পোর্টালগুলো বিজ্ঞাপনের নামে চাদাবাজি করছে। ফলে নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল, যাদের অফিস আছে রিপোর্টার আছে, সার্ভার মেন্টেনেন্স ও আছে আইটি খাতে খরচ তা সত্বেও পিছিয়ে পড়ছে তারা। অনিবন্ধিত অনলাইন পত্রিকার চাঁদাবাজির কারণে তথ্য অধিদপ্তরের নিবন্ধিত অনলাইন পোর্টালগুলো পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত কোম্পানির বিজ্ঞাপন সেভাবে পাচ্ছে না।

আবার এসব অনলাইন পত্রিকার অনেকেরই অফিস নেই, বাসায় বসে অন্য কাজের ফাকে ফাকে ক্ষেত্রবিশেষে একজন বা দুইজন দিয়েই চলছে সে সকল পোর্টাল। নামে-বেনামে ফেক ঠিকানায় চলছে অধিকাংশ অনলাইন পোর্টাল। প্রাতিষ্ঠানিক কোন খরচ না থাকায় দশ হাজার টাকার বিজ্ঞাপন তারা এক হাজার টাকায় পাবলিশ করছে ফলে নষ্ট হচ্ছে নিবন্ধিত অনলাইন নিউজ পোর্টালের বিজ্ঞাপনের বাজার।

ইতিমধ্যে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রনালয় ১১৫টি নিউজ পোর্টাল ও ১৪টি আইপি টিভিকে নিবন্ধন প্রদান করেছে। অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন এই পদক্ষেপের কারণে সামাজিক অবক্ষয় কমে আসবে এবং অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও টেলিভিশন চ্যানেলের নামে যে নৈরাজ্য চলে আসছিলো তা বন্ধ হবে।

সুতরাং সামাজিক অবক্ষয়, চাঁদাবাজি ও বিজ্ঞাপনের নামে হুমকি ধামকি তথা মানহানিকর তথ্য প্রচার বন্ধের জন্য অতিসত্তর উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন জরুরি ও অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ছে। কাজেই বিভিন্ন অজুহাতে কালক্ষেপন না করে অতিসত্তর উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য তথ্য মন্ত্রনালয়, বিটিআরসি ও বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া উচিত।