ওয়াহিদা আক্তার: ‘যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি’ অমর কবিতার কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের জন্মস্থান খুলনা জেলার দিঘলিয়া উপজেলার সেনহাটি গ্রামে। তিনি ৩১ মে ১৮৩৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ভৈরব নদের পাড় ঘেঁষে ওপারে সারি সারি জুট মিল, স্টার জুট মিল, নিউজপ্রিন্ট মিল, ক্রিসেন্ট জুট মিল, পিপলস জুট মিল, গোয়ালপাড়া পাওয়ার হাউস, বার্মাশেল কোম্পানির তেলের ডিপো এপার থেকে সহজেই চোখে পড়ে। অনন্ত যৌবনা ভৈরব নদ, আতাই নদী ও মজুদখালী নদী তিনটি ঘিরে রেখেছে দিঘলিয়া উপজেলাকে।
প্রায় ১২-১৪টি খেয়াঘাট দিয়ে দ্বীপসদৃশ এ উপজেলার লোকজন শহরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। সেনহাটি গ্রামটি এক সময় খুব সমৃদ্ধ ছিল। এপারে ছিল সারি সারি পাটের গোডাউন। পাটকলের শিফট পরিবর্তনের সিটি শুনে আমাদের দিন শুরু হতো।
হাজার হাজার শ্রমিকের নদী পারাপারে এ এলাকা সরগরম থাকত। সপ্তাহান্তে শ্রমিকের মজুরি পেত, সেটাকে লক্ষ্য রেখে সেনহাটি বাজারে পণ্য সম্ভারে ভরে উঠত। ভৈরব নদের কোল ঘেঁষে জুট মিলের সাদা রং-এর বাংলো আমাদের কাছে স্বপ্নের বাড়ি বলে মনে হতো। এপারের সবচেয়ে বড় আলিয়া মাদরাসা, শিবমন্দির, ঈদগাহ ও মসজিদের পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িক অবস্থান ছিল।
বড় বড় অভিজাত শ্রেণির হিন্দু পরিবারের বসত ছিল সেনহাটিতে। দুর্গামূর্তি, কালীমূর্তি তৈরি হতো সেনহাটি স্কুলের পেছনে পালপাড়ায়। দূর-দূরান্ত থেকে রঙিন পাল তোলা বড় বড় নৌকা এসে ভিড়ত। পূজার আগে এসব দেবীমূর্তি কিনতে আসত। শুনেছি কলকাতা থেকেও এসব বড় বড় নৌকা আসত।
এমনই একটি অসাম্প্রদায়িক মায়াময় পরিবেশে আমাদের বেড়ে ওঠা। ১৮৮৭ সালে স্থাপিত সেনহাটি হাইস্কুল থেকে বের হয়েছেন বহু কীর্তিমান ছাত্র। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে এদের অবদান স্মরণীয়। পূর্ব পুরুষের কীর্তিময় স্থানে এখনো বেড়াতে আসেন তাদের পরবর্তী প্রজন্মের বংশধররা।
মাধ্যমিক স্কুলে পড়ার সময় ভাবসম্প্রসারণ করতে হতো সব কবিতার চরণ। তার অধিকাংশ ছিল কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের লেখা কাব্যগ্রন্থ সদ্ভাবশতক থেকে নেওয়া- “যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি, আশু গৃহে তার দেখিবে না আর নিশীথে প্রদীপ ভাতি” অথবা “কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে, দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহিতে”। কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের জন্মস্থান সেনহাটি গ্রামে। আমাদের গ্রামে জন্ম নেওয়া এই মহান কবি আমাদের গর্ব। নীতিশাস্ত্র হিসেবে ‘সদ্ভাবশতকের কবিতাগুলো তৎকালীন সমাজে আলোড়ন তোলে। নীতি ও নৈতিকতার প্রশ্নে যা আজও প্রাসঙ্গিক। এসব কবিতা শৈশবে সুখপাঠ্য বা মর্মার্থ অনুধাবনের মতো পরিপক্বতা ছিল না। কিন্তু এই বাণীর ছাপ বোধ হয় অন্তরে থেকে যায়। কবি তাঁর বাণীর মধ্যে জীবন জগতের যে মাহাত্ম্য তুলে ধরেছেন তা চিরন্তন সত্য বাণী। বাংলা ভাষাভাষী সমাজে ‘সদ্ভাবশতক’ কাব্যের প্রভাব এখনো বিরাজমান। “চিরসুখী জন, ভ্রমে কি কখন ব্যথিত বেদন বুঝিতে কি পারে,” “একদা ছিল না জুতা চরণ যুগলে, স্বদেশের উপকারে নাই যার মন, কে বলে মানুষ তারে, পশু সেই জন” কেন পান্থ! ক্ষান্ত হও হেরি দীর্ঘ পথ? উদ্যম বিহনে কার পুরে মনোরথ, পরের অভাব মনে করিলে চিন্তন, আপন অভাব ক্ষোভ রহে কতক্ষণ? “শুক্তির কুরুপ দৃষ্টে তুচ্ছজ্ঞান হয়, কিন্তু তাতে মুক্তো মেলা অসম্ভব নয়”। “গাইত যদ্যপি শশী গুন আপনার, হত কি সে তবে এত প্রিয় সবাকার”?
ইত্যাদি কবিতার চরণ বাংলাদেশের মানুষের সুনীতি শিক্ষায় মহান দায়িত্ব পালন করে চলেছে। আজও মানুষের মুখে মুখে কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের রচিত এ কবিতাগুলো উচ্চারিত হয়।
কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার ও তাঁর কাব্যের সঙ্গে আজকের প্রজন্মের কোনো পরিচয় নেই। ১৮৬১ সালে এ কাব্য প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন এক বছরের শিশু। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের মহাকাব্য মেঘনাদ বধ কাব্য একই সময়ে প্রকাশিত। কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর সমসাময়িক কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার। সমসাময়িক বিখ্যাত সব কবিদের মধ্যে তিনি ভিন্নধারার কবিতার অবতারণা করেন।
অনেকে বলেন, বাংলা কবিতার নবজন্মের পূর্বাহ্নে কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার পারস্যের কবি শামসুদ্দিন হাফিজ ও শেখ সাদীর কবিতা প্রভাবিত মৌলিক কবি। জীবন গভীরে উপলব্ধি, বিস্ময়, বিশ্লেষণ, সৎচিন্তা, সুনীতি, সদুপদেশ ইত্যাদি বিষয়ে পারস্য কবি হাফিজ ও শেখ সাদী বিশ্বনন্দিত। সদ্ভাবশতকের কবিতা নীতিমূলক ও তত্ত্বপূর্ণ। আত্মা ও মনুষ্যত্বের বিকাশে বিকশিত।
আগেই বলেছি বাংলা ভাষার নীতিশাস্ত্র খ্যাত সদ্ভাবশতকের কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারে জন্ম খুলনা জেলার দিঘলিয়া উপজেলার সেনহাটি গ্রামে। কৃষ্ণচন্দ্রের বয়স যখন ছয় মাস তখন তিনি পিতৃহারা হন। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার বিস্তারিত জানা যায় না। পাঁচ বছর বয়সে তাঁর হাতেখড়ি হয় গ্রামের পাঠশালার গুরুমশাইয়ের কাছে। সেনহাটি বরাবরই শিক্ষা সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ গ্রাম ছিল। সে সময়ে সংস্কৃত ও ফারসি শিক্ষার সুযোগ ছিল। গিরিশচন্দ্র সেনের (পবিত্র কোরআন শরিফের অনুবাদক নন) কাছে তাঁর ফারসি শিক্ষা শুরু হয়। দারিদ্র্যের কারণে কবির মাতা ব্রহ্মময়ী সেনহাটি ছেড়ে শিশুপুত্রকে নিয়ে কবি পিতার মাতামহ প্রসন্নকুমারের আশ্রয় গ্রহণ করেন। তাঁর উদ্যোগেই কৃষ্ণচন্দ্রের প্রকৃত শিক্ষা লাভ হয়। তিনি সংস্কৃত ও ফারসি ভাষাতে বিশেষ পারদর্শী হয়ে ওঠেন। এরপর কৃষ্ণচন্দ্র ঢাকায় তাঁর এক আত্মীয় গৌরচন্দ্র দাশের কাছে আশ্রয় নেন। তিনি ছিলেন ঢাকা জজ কোর্টের নামকরা উকিল। তাঁর বদান্যতায় কৃষ্ণচন্দ্র ঢাকার স্কুলে লেখাপড়া করেন।
লেখাপড়া শেষ করে তিনি নিজ গ্রাম সেনহাটিতে ফিরে আসেন এবং কাব্যচর্চা শুরু করেন। জীবন-জীবিকার তাগিদে তিনি বরিশালের কীর্তিপাশা বাংলা বিদ্যালয়ে প্রধান পন্ডিত হিসেবে দায়িত্ব নেন। পরে বেতন কম থাকায় তিনি ১৫ টাকা বেতনে সার্কেল পন্ডিত পদ লাভ করেন। ১৮৫৭ সালে তিনি মানিকগঞ্জের সুয়াপুর গ্রামের উমাশঙ্কর সেনের কন্যা শ্রীমতী অমৃতময়ী দেবীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিবাহিত জীবন তাঁর সুখের ছিল। দুই পুত্র ও চার কন্যাসন্তানের জনক ছিলেন তিনি।
১৮৬১ সালে মৌলভী আবদুল করিমের মালিকানায় ‘ঢাকা প্রকাশ’ পত্রিকায় ২৫ টাকা বেতনে সম্পাদক নিযুক্ত হন। জানা যায়, চরম দারিদ্র্যপীড়িত ও অসুস্থ অবস্থায় সদ্ভাবশতকের গ্রন্থস্বত্ব ১৫০ কিংবা ২৪৫ কিংবা ৩০০ টাকায় নন্দকুমার গুহের কাছে বিক্রি করে দিয়ে আসেন। অসুস্থ অবস্থায় তিনি আবারও সেনহাটিতে ফিরে আসেন।
লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকতে পছন্দ করতেন। অস্থায়ীভাবে দৌলতপুর স্কুলে চাকরিকালীন অর্থকষ্ট তীব্র আকার ধারণ করলে তিনি ১৮৭৪ সালে ২৫ টাকা বেতনে যশোর জেলা স্কুলে হেড পন্ডিত হিসেবে কাজ করেন। যশোর জেলা স্কুলে ১৯ বছর চাকরি করার পর ১৮৯৩ সালে তিনি স্বেচ্ছায় অবসর নেন। পেনশনের সামান্য কিছু টাকা নিয়ে তিনি সেনহাটিতে আবার ফিরে আসেন। ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠ ও বাড়ির পাশে কামিনী ফুল গাছের নিচে অধিকাংশ সময় কাটাতেন। দারিদ্র্য, অর্থকষ্ট, রোগ শোকে তিনি ১৯০৭ সালে ১৩ জানুয়ারি ৬৯ বছর বয়সে ইহধাম ত্যাগ করেন। তাঁর নির্ভীক চিত্তের উচ্চারণ ঃ ওহে মৃত্যু তুমি মোরে কি দেখাও ভয়? ও ভয়ে কম্পিত নয় আমার হৃদয়।
কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের নামে ১৯১৪ সালে স্থাপিত একটি ইনস্টিটিউট সেনহাটি বাজারের পাশে আছে। ভগ্নদশা ও জরাজীর্ণ একটি কক্ষে কিছু পুরাতন বইপত্র আছে। সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্র হিসেবে কৃষ্ণচন্দ্র ইনস্টিটিউট ব্যবহৃত হয়। কবির জীবন পর্যালোচনা করে দেখা যায় বারবার তিনি জন্মস্থানে ফিরে এসেছেন, সেনহাটি গ্রামের সম্মুখে বয়ে চলা ভৈরব নদ, সারি সারি নারিকেল গাছ, তাঁর প্রিয় কামিনী ফুল গাছ তাঁকে সহায় সংকটে ফিরিয়ে এনেছে জন্মস্থান সেনহাটি গ্রামে। কবির ব্যাকুল হৃদয়ের বাসনা তাঁর কবিতার চরণে “এই ত সে প্রিয়তম মম জন্মস্থান, যার তরে ছিল সদা ব্যাকুলিত প্রাণ”; বাংলাদেশের কোথাও কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের কোনো স্মৃতি স্মারক নেই। এ বিষয়ে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
তথ্যসূত্র : কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার ও সদ্ভাবশতক
লেখক : ওয়াহিদা আক্তার, সচিব, কৃষি মন্ত্রণালয়।
© ২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | কর্পোরেট সংবাদ সম্পাদক - মোঃ মিজানুর রহমান । উপদেষ্টা সম্পাদক- জেসমিন আক্তার, এফসিএস ই-মেইলঃ corporatesangbad@gmail.com । ফোনঃ ০২২২-৩৩৫৪১২৫ । মোবাইলঃ ০১৭১১০৭৬৮১৫ অফিসঃ ৫৫/বি, নোয়াখালী টাওয়ার, ১১ তলা, সুইট ১১-এফ, পুরানা পল্টন, ঢাকা ১০০০ |
‘যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি’ https://corporatesangbad.com/36727/ |