ব্রিগে: জেনা: শরীফ আজিজ, পিএসসি (অব:): ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সকালে বঙ্গভবন থেকে আমরা তিন জন ছুঁটে গিয়েছিলাম ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের দিকে। আমরা ছিলাম ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাশহুরুল হক, ক্যাপ্টেন শরীফ আজিজ ও লেফটেন্যান্ট রাব্বানী। প্রথম জন বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব আর অপর দু’জন বঙ্গবন্ধুর এডিসি। আমাদের লক্ষ্যস্থল বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়ি হলেও সেখানে আমরা পৌঁছাতে পারিনি। যেমন গণভবন থেকে আসা বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিলও পারেন নি। ১৫ই আগস্টের খুব সকালে অভ্যুত্থানকারীরা কর্নেল জামিলকে হত্যা করে। তবে বঙ্গভবন থেকে আসা আমাদের তিনজনকে অভ্যুত্থানকারীরা প্রাণে মেরে না ফেললেও গাড়ি থেকে টেনে হিচড়ে নামিয়ে চোখ বেঁধে ফেলে এবং আটকে রাখে। আমাদের সেই তিন জন সামরিক কর্মকর্তার মধ্যে আমি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ আজিজই এখনও বেঁচে আছি।
২। ১৫ই আগস্ট যে এরকম একটি হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটবে, তা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি সর্ব কালের সর্ব শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালীকে এরকম নৃশংসভাবে হত্যা করা হবে। যখন এটা ভাবি, তখন খুবই অনুশোচনায় পড়ি, বিচলিত হই, আত্মগ্লানিতে ভুগি এবং খুবই লজ্জা লাগে। আমরা যারা বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলাম, কেউই বুঝতে পারলাম না, কী ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুকে বলা হয়েছিল, ৩২ নম্বর রোডের বাসায় থাকবেন না, গণভবনে থাকুন। তিনি বললেন, ৩২নং রোডের বাসাতেই তিনি থাকবেন। এর পর আর কেউ তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেন নি। মনে আছে, তাঁর মৃত্যুর তিন-চার দিন আগে হত্যাকারীদের একজন কর্নেল ফারুক কোনো এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন জানিয়ে ছিলেন। এসব লোকই কিনা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করল? আমরা কিছুই বুঝতে পারলাম না। ডিজিএফআই, এনএসআই কেউই জানল না, এটি কীভাবে সম্ভব হলো? এটা ছিল আমাদের চরম ব্যর্থতার জল জ্যান্ত একটি ইতিহাস।
৩। তাহলে সেই ব্যর্থতার দায়ভার কার ? এর উত্তরে বলব, অবশ্যই আমাদের ব্যর্থতা ছিল। বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে পারিনি, এ ব্যর্থতা গোটা জাতির বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তায় পিজিআরের বাইরে বেসামরিক নিরাপত্তা কর্মকর্তারাও ছিলেন। আজ এত বছর পর এসে মনে হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তায় বড় ধরনের ঘাটতি ছিল। কর্ণেল ফারুক ও রশিদ চক্র এই পরিকল্পনা করেছে, তার কিছুই আমরা টের পাইনাই কেন ? এসকল প্রশ্ন আমাকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাড়া করে বেড়াবে। বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা বঙ্গবন্ধুকে হয়ত সতর্ক করে থাকতে পারে। কিন্তু আমার অনুযোগ দেশের ভেতরে এত গোয়েন্দা সংস্থা, এত বাহিনী, কেউই বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্র টের পেল না? এখন মনে হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার বিষয়টি খুবই ঢিলেঢালা ছিল। ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট পিজিআর প্রতিষ্ঠিত হলেও, উক্ত রেজিমেন্ট বঙ্গবন্ধুর বাড়ির নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল না। নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে আসা একটি সেনা গোলন্দাজ ইউনিট। মোটকথা রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সকলকেই দায়ী করা যায়। এটি ছিল সংশ্লিষ্টদের অবহেলা, যা হয়ত ইচ্ছাকৃত নয়। তবে এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, আমরা যারা Personal Staffs ছিলাম – তাদের “নিরাপত্তা” বিষয়ে কোন দায় দায়িত্ব ছিল না। নিরাপত্তার প্রধান দায়িত্ব বর্তায় Chief Security Officer এর উপর এবং তখনকার গার্ড রেজিমেন্টের উপর।
৪। ১৫ই আগস্টের ঘটনা আমরা কীভাবে শুনলাম এবং কীভাবে আমরা বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাওয়ার উদ্যোগ নিলাম এটা নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে এর কিছুটা বর্ণনার প্রয়োজন আছে। ঘটনার দিনই আমরা তিন এডিসি’র দায়িত্ব নির্ধারিত ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে ১৫ই আগষ্ট সকালে বঙ্গবন্ধুর সমাবর্তনী অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা ছিল। তবে সকালবেলা ৬ টার দিকে গণভবনের ফখরুল ইসলাম নামের একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা গণভবনথেকে আমাকে টেলিফোন করে জানায় যে, “ধানমন্ডি ও মিরপুর রোডের দিক থেকে গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। আপনারা কিছু শোনেননি?” আমি বললাম, না, শুনিনি। এর মধ্যে আরো কারোকারো কাছ থেকে দু:সংবাদের খবর নেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে কোন কিছু অন্য কোন চিন্তা বা কোন কিছুর ভ্রক্ষেপ না করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলাম বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাব। আমি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাশহুরুল হককে জানালাম, তিনি বললেন, তিনিও যাবেন। গাড়িতে উঠার আগে তিনি আমার হাতে একটি পিস্তল দিয়ে সাথে রাখতে বললেন, আমি অপর এডিসি যিনি আমার পাশের রুমে থাকতেন, লেঃ রাব্বানীকেও ঘটনা বললাম। তিনিও যাওয়ার কথা বললেন। আমরা তিনজনই ছিলাম সিভিল পোশাকে। এর পর আমরা বঙ্গভবনথেকে একটি গাড়ি নিলাম, পুরোনো ভক্সওয়াগন। রাজা মিয়া নামের একজন ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছিলেন। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, প্রধান রাস্তা এড়িয়ে আজিমপুর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে, কিছুক্ষণ পর যে অনুষ্ঠান হবে তার প্রস্তুতি দেখে বঙ্গবন্ধুর বাড়ী যাব। এরপর যখন নিউমার্কেট পার হয়ে ধানমন্ডির ২ নম্বর সড়কে এলাম, তখন কালো ইউনিফর্ম পরিহিত কোরের (Tank বাহিনীর) লোকেরা জিজ্ঞেস করল, আমরা কোথায় যাচ্ছি? আমরা জানালাম, বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাব। ওরা বলল, তাকেতো হত্যা করা হয়েছে। আমরা বললাম, কী বলছ? তোমরা কি পাগল? কিন্তু আমরা তাদের বাধা পেরিয়ে সামনে এগোলাম। এরপর কলাবাগান স্টাফকোয়ার্টারের কাছে ফের আরেকদল আমাদের আটকাল। নানা কৌশলে দ্বিতীয় বাধাও পার হলাম।
৫। তখন রাস্তায় কোন সাধারণ লোকজন ছিল না। কেন না তখনতো কারফিউ চলছিল। বিদ্রোহী সেনাদের তৃতীয়দল আমাদের বাধা দিল বঙ্গবন্ধুর বাড়ির কাছে, সাংহাই চীনা রেস্তোরাঁর নিকটে ওরা আমাদেরকে গাড়ি থেকে নামিয়ে টেনে হিঁচড়ে লেকের পাড়ে নিয়ে আটকে ফেলল। তারা ছিল খুবই আক্রমণাত্মক। অকথ্য ভাষায় আমাদেরকে গালাগাল করল। আমাকে পিঠে ও পেটে বিশাল জোরে কতগুলি ঘুষি দিল, কেননা আমার পকেটে ছিল ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাশহুরুলের দেয়া ছোট পিস্তলটি। এরপর তারা আমাদের সবার চোখ বেঁধে ফেলল। পিছমোড়া করে হাত বাঁধল। চোখ বেঁধে ফেলায় ভাবলাম, এটা হয়তো হত্যার আগের প্রস্তুতি। আমাদের আর নিস্তার নাই। ওদের কথাবার্তায় টের পেলাম, কর্মকর্তাগোছের কেউ কেউ ওখান দিয়ে আসা-যাওয়া করছিল। তাদের প্রশ্নের উত্তরে সেনারা বলল, ‘তিন গাদ্দারকে ধরেছি।’ একবার কর্ণেল ফারুকও ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। সেনারা তাঁকে আমাদের বিষয়ে জিজ্ঞেস করল, তারা আমাদেরকে কী করবে ? তিনি আমাদের দুজনকে না চিনলেও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাশরুল হককে চিনলেন। কর্ণেল ফারুক বললেন, “এদেরকে ধরে রাখো।”
৬। এভাবে আমাদের চোখ বেঁধে সেখানে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা রাখা হলো। কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের বোনজামাই মরহুম মেজর শহীদুল্লাহ আমাদের অবস্থা দেখে আমাদেরকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে উদ্ধার করলেন এবং গণভবনে নিয়ে গেলেন। সেখানে আমাদের চোখ খুলে দিয়ে একটি কক্ষে আটকিয়ে রাখা হলো। দিনটি ছিল শুক্র বার। নামাজের সময় হলে কর্তব্যরত প্রহরীদের বুঝিয়ে বন্দী অবস্থা থেকে বেরিয়ে গণভবনের মসজিদে নামাজ পড়লাম। সন্ধ্যায় গণভবনের Comptroller, যিনি আমাদের পূর্ব পরিচিত ছিলেন, তিনি একটি গাড়ীর ব্যবস্থা করে দিলে প্রহরারত সৈনিকদের ফাঁকি দিয়ে আমরা বঙ্গভবনে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি, কর্নেল আমীন আহম্মেদ চৌধুরী ( পরবর্তিতে মেজর জেনারেল) নতুন সামরিক সচিব হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহন করেছেন এবং হাতে ব্যাজপরে আছেন। এর মধ্যে তিন বাহিনী থেকে তিনজন নতুন এডিসি নিয়োগ পেয়ে তাদের দেখলাম আমাদের জায়গায় ডিউটি করতে। আরো শুনলাম আমাদের অন্যত্রে পোস্টিং করা হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ সন্ধ্যায় শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে ফের আমাদের ডাক পড়ল। আসলে যাঁরা নতুন যোগদান করে ছিলেন, তাঁদের ওই ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনের অভিজ্ঞতা ছিলনা বলেই আমাদের ডাক পড়েছিল। তবে সারাদিনের ধকলে আমরা ছিলাম ভীষনভাবে ক্লান্ত। ভয়েভয়ে আমরা নতুন সামরিক সচিবকে রিপোর্ট করলাম। উনি আমাদেরকে নির্দেশ দিলেন আমরা যেন শপথ অনুষ্ঠানটি সুচারুভাবে সমাপ্ত করি। ঐ দিনের শপথ অনুষ্ঠানের একটি ছবিতে আমাকে অতি বিষন্ন এবং হতবিহব্বল দেখা যাচ্ছিল। বোঝাই যাচ্ছিল কতটা বিড়ম্বনার মধ্যে ছিলাম সেদিন।
৭। এরপর বঙ্গভবনেই এক ধরনের বৈরী পরিবেশে আড়াইমাস কেটেগেল। আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া কোনো দায়িত্ব ছিলনা আমাদের। বঙ্গবন্ধুর প্রাক্তন এডিসি হিসেবে বঙ্গভবনে কর্মরত অন্যরা আমাদের এড়িয়ে চলত। কর্ণেল ফারুক ও কর্ণেল রশিদ বঙ্গভবনের তৃতীয়তলায় ভিআইপি রুমে থাকতেন। তাঁদের মধ্যে এক ধরনের অহংকার এসেগেল যে, ‘তারাই দেশ চালাচ্ছে।’ কিছু দিন যেতেনাযেতেই পুরো সেনাবাহিনী তাঁদের বিরুদ্ধে চলেগেল। বিশেষকরে সেনা বাহিনীর জেষ্ঠ্য কর্মকর্তারা কোনোভাবেই তাঁদের কর্তৃত্ব মেনেনিতে পারছিলেন না।
৮। যেহেতু সার্বিকভাবে সেনাবাহিনী এই সামরিক অভ্যুত্থানে জড়িত ছিলনা, সেহেতু পুরো সেনাবাহিনী ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে পড়েছিল। বরং সেনাবাহিনী আড়াইমাস সময়ের মধ্যে অভ্যুত্থানকারীদের স্থান চ্যুতি করে দিয়েছিল। সুতরাং সেনাবাহিনীকে উক্ত সামরিক অভ্যুত্থানের জন্য দায়ী করা যাবে না। কিন্তু সেনাবাহিনীর সিনিয়র কমান্ডকর্তৃক ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যা কান্ডর পর, ঘটনাস্থলে যাওয়া সকলেরই আকাংখিত ছিল। ঘটনার পর, স্থানীয় সেনা অধিনায়ক ঘটনাস্থল পরিদর্শন এবং সেনাবাহিনী পাঠাতে ব্যর্থ হয়েছিল। যেকোনো বিবেচনায়ই এটা ছিল একটি চরম ব্যর্থতা।
৯। এরপর ৩রা নভেম্বর, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সেনা অভ্যুত্থান হলো। সেটা একটি অন্যরকম স্মৃতি। তবে আমরা চেয়েছিলাম ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ সফল হোন। খুনিরা পালিয়ে গেল। তার আগে একটি বৈঠকেতো একজন সেনা কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের মেরে ফেলার হুমকিও দিয়েছিলেন। তবে সে সময় উক্ত বৈঠকে আমরা পুরোনো এডিসিদের মধ্যে কেউ উপস্থিত ছিলাম না। চারদিকে থমথমে অবস্থা। বঙ্গভবনের বাইরে অরাজকতা চলছিল। নভেম্বর মাসের ৬-৭ তারিখে ‘সিপাহীসিপাহী’ ‘ভাইভাই’ বলে পাল্টা অভ্যুত্থান হলো। ইতিমধ্যে জেলখানায় জাতীয় চারনেতাকে হত্যা করা হল। কিন্তু জেলখানায় জাতীয় চার নেতার হত্যা সম্পর্কে আমরা পুরো অন্ধকারে ছিলাম। পরে যখন জেনেছি তখন খুনিরা দেশ ছেড়ে চলে গেছে। জেল হত্যার বিষয়টি গোপন রাখা হয়েছিল। পরবর্তিতে বিচারপতি আবু সাদাত সায়েম রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হলে, আমাদের বদলির আদেশ বাতিল করা হয় এবং সেনা সদরের আদেশক্রমে পূর্ববর্তী ( এডিসি ) কার্য্যক্রমে ফিরে যাই।
১০। এই মহা বিষাদের ঘটনা শেষ করার আগে বঙ্গবন্ধু সম্বন্ধে কিছু বিশেষ কথা বলতে চাই। যেমন বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশাল হৃদয়ের একজন মানুষ। এডিসি হিসেবে আমরা বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যের মতো ছিলাম। সকালে বঙ্গভবনথেকে ৩২ নম্বরে আসতাম, রাতে ফিরে যেতাম। প্রতিদিন বাসায় গেলে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব আমাদের খেতে বলতেন। তাঁর মাতৃসূলভ ডাকে বেশীরভাগ সময়ই না খেয়ে আসতে পারতাম না। আর খেতেনা চাইলে ও বঙ্গবন্ধু খেয়ে যাওয়ার জন্য তাগাদা দিতেন, তাঁর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ছিল পিতা ও পুত্রের মত। তার সঙ্গে যারাই কাজ করেছেন, তিনি তাদের সবার পরিবারের খোঁজ খবর নিতেন। নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনী থেকে বঙ্গবন্ধুর আরও দুজন এডিসি ছিলেন। আমাদের তিনজনকে’ই তিনি খুব ভালো বাসতেন।
১১। বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সরল মনের একজন বড় মাপের মানুষ ছিলেন। তাঁর জন্য আমরা জীবন দিতেও প্রস্তুত ছিলাম। কর্তব্যের তাগিদেই সেদিন আমরা তিন জন সামরিক কর্মকর্তা বঙ্গভবন থেকে তাঁর বাসার দিকে ছুটে গিয়েছিলাম। এই সাহসিকতার জন্য পরবর্তীতে কি এর কোন মূল্যায়ন হয়েছে এই প্রশ্ন আমাকে অনেকে করেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে এতদিন পরও এইঘটনার প্রেক্ষিতে মূল্যায়নের জন্য কোন তদবির বা দেনদরবার করিনি। আমাদের Action ছিল Spontaneous, যেটাকে ইংরেজিতে বলে “Call of Duty” এখানে সাহসিকতা ছাড়াও ‘কর্তব্যের খাতিরে সাড়া’ কথাটিই মুখ্য ছিল। মোট কথা, বঙ্গবন্ধুকে আমরা বাঁচাতে পারি নাই, এই গ্লানি এবং মনোবেদনা সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। তবে মূল্যায়ন, পদক, বড়কোন পদ ইত্যাদির ব্যাপারে কেন আমার অনিহা / অপারগতা – এধরনের কথা প্রতিবছরই ১৫ই আগষ্টের পর আমাকে কেউকেউ করে থাকে আমি তখন বলি যে, দেখেন বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রির সাথে বছরে আমার দুই / তিনবার, যেমন স্বাধীনতা দিবস, Victory Day এবং সশস্ত্র বাহিনী দিবসে দেখা হয়, তখন – উনি কৌতুকের ছলে বলেন যে আপনার দাড়িত দেখছি খালি বড় হচ্ছে। অতি সংক্ষিপ্ত কুশলাদি বিনিময়ের পর আমি সহাস্যে একটি স্মার্ট সালাম দিয়ে উনার মঙ্গল কামনা করে প্রতিবারই বিদায় নিই।
১২। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যে মহান ব্যক্তিটি আমাদের স্বাধীনতার অগ্রদূত, জাতি হিসাবে তাঁর প্রতি আমাদের দায়িত্ব কি? ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, যে মহান পিতার প্রতি আমাদের চির কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। সত্যিকার অর্থে বলতে হয়, বঙ্গবন্ধুর ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে আমি সেনাবাহিনীর একজন বড় অফিসার হতে পারতাম না, বা অবসর গ্রহণের পরবর্তী জীবনে ২০,০০০ +- জনবল বিশিষ্ট "এলিটফোর্স "নামক এত বড় প্রাইভেট সিকিউরিটি কোম্পানির মালিক হতে পারতাম না। যদিও বঙ্গবন্ধুর নিষ্ঠুরতম হত্যা কান্ডের পর ষ্টাফঅফিসার হিসেবে আমাদের স্থিতিকাল সংক্ষেপণ করা হয়েছিল, তথাপি সেনাবাহিনীর পক্ষথেকে বঙ্গবন্ধুর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালনের সূযোগ পেয়ে আমি অতি গর্বিত। জাতির পিতার প্রতি আমাদের ঋণ অপরিশোধনীয়, তথাপি উনার প্রতি আমাদের সর্বোচ্চ সম্মান, গভীর শ্রদ্ধা, অপরিসীম কৃতজ্ঞতা ও আন্তরিক ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ প্রতি বছর ১৫ই আগষ্ট আমরা এলিট ফোর্সে রক্তদান কর্মসূচি ও দোয়া মাহফিলের আয়োজনের মাধ্যমে উনার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
১৩। আমার স্মৃতিচারনে যে সকল তথ্য দিলাম এর সমর্থন পাওয়া যাবে অ্যান্থনি মাস্কারেনহাসের বই ‘লিগ্যাসি অব ব্লাড’ এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার দায়ে মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আসামি কর্ণেল মহিউদ্দিনের আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে।অ্যান্থনি মাস্কারেনহাস লিখেছেন, মিরপুর রোড ধরে শেখমুজিবের বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একদল ল্যান্সারের আহ্বানে কর্নেল ফারুকুর রহমান সেখানে নামেন এবং দেখতে পান যে, আমাদের তিন জনকে ধরে অত্যন্ত শক্তভাবে বেঁধে রেখেছে। উত্তেজিতভাবে তারা বলছে, মুজিবের বাড়ির দিকে যাওয়ার চেষ্টা করায় তারা আমাদেরকে পাকড়াও করেছে। তারা কর্ণেল ফারুকের কাছে জানতে চায়, ‘আমাদের খতম করে দেবে না কি?’ কর্ণেল ফারুক আমাদের মধ্যকার কমবয়সী দুজনকে চিনতে নাপারলেও দেখা মাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাশহুরুল হককে চিনেফেলে। কর্ণেল ফারুক তাঁর সেনাদের শান্ত করলেন এবং বললেন, আর কোনো খুনের প্রয়োজন নেই। অপর দিকে মহিউদ্দিন তাঁর জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, হঠাৎ তিনি লেকের দিকে হইচইয়ের শব্দশুনে সেদিকে তাকিয়ে দেখেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাশহুরুল হক ও রাষ্ট্রপতির দুই এডিসিকে চোখ বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে। তাদের হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। ল্যান্সার ইউনিটের সেনারা তাদের গুলি করতে উদ্যত হন।
১৪। আমাদের ঐদিনের আরো বিড়ম্বনার বিবরণ এন্থনি ম্যাসকারেন হাসের লিখিত English Version ‘‘Bangladesh : A Legacy of Blood’ নামক বইয়ের ৭৭ পৃষ্ঠার তৃতীয় অনুচ্ছেদে এবং বাংলা অনুবাদ ‘বাংলাদেশ:রক্তের ঋণ’ বইয়ের ৯৪, ৯৫ নং পাতায় বর্ণিত হয়েছে। এছাড়াও পরবর্তিতে ১৯৯৬-৯৭ সালে আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে নতুনভাবে ৫০০০ হাজার পৃষ্ঠার অনুসন্ধানী রিপোর্টেও এই ঘটনাবলীর উল্লেখ্য আছে। প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের এক ভগ্নিপতি অবসর প্রাপ্ত মেজর শহীদউল্লাহ ওইদিন আমাদের এই করুণ অবস্থা স্বচক্ষে দেখে ছিলেন।
অন্য ভাবনা: ২০২১ সালে আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছরে উপনিত হয়েছি। সর্ব কালের সর্ব শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা, বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, স্বাধীনতার রূপকার, স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু যদি আজ বেঁচে থাকতেন- উনি দেশকে কিভাবে দেখতে চাইতেন। আমার মনে হয় উনি আমাদের এই চরম বিভক্তি কোন মতেই মেনে নিতে পারতেন না। গরীব দেশের অনেক উন্নতি হলেও ধনী-গরিবের বৈষম্য উনাকে বিচলিত করতো। দুর্নীতিরোধে যে আমরা ব্যর্থ তা উনাকে লজ্জিত করতো। যে কোন অবস্থাতেই হোক না, গণতন্ত্রকে যেভাবে আমরা উপেক্ষা করছি তা দেখে উনি হতবাক হতেন। আজ বঙ্গবন্ধুর ৪৬ তম শাহাদত দিবসে তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করছি।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ আজিজ, পিএসসি (অবঃ)
ব্যবস্থাপনা পরিচালক
এলিট সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেড
মোবাইল : ০১৭১১-৫২৫৬১৭, ০১৮৪১-৫২৫৬১৭
ই-মেইল : sharif@elitebd.com
তারিখ : ০৮ আগষ্ঠ ২০২১ ইং
© ২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | কর্পোরেট সংবাদ সম্পাদক - মোঃ মিজানুর রহমান । উপদেষ্টা সম্পাদক- জেসমিন আক্তার, এফসিএস ই-মেইলঃ corporatesangbad@gmail.com । ফোনঃ ০২২২-৩৩৫৪১২৫ । মোবাইলঃ ০১৭১১০৭৬৮১৫ অফিসঃ ৫৫/বি, নোয়াখালী টাওয়ার, ১১ তলা, সুইট ১১-এফ, পুরানা পল্টন, ঢাকা ১০০০ |
বঙ্গবন্ধু হত্যা: ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫, আমাদের ছিল চরম ব্যর্থতা https://corporatesangbad.com/367142/ |