আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানালেন তামিম

Posted on July 6, 2023

স্পোর্টস ডেস্ক : অশ্রুসিক্ত চোখে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবাল।

বৃহস্পতিবার (৬ জুলাই) বন্দরনগরীর জুবিলি রোডের ‘টাওয়ার ইন’ হোটেলে এক সংবাদ সম্মেলেন এ ঘোষণা দেন তিনি।

বিদায়ের কথা বলতে গিয়ে এক পর্যায়ে ধরে আসে তার কণ্ঠ। মাথা নিচু করে চোখের জল মুছতে দেখা যায় তাকে। ১৬ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে পাশে থাকার জন্য তামিম ধন্যবাদ জানান কোচ, বিসিবিসহ সতীর্থদের।

সংবাদ সম্মেলনে তামিম বলেন, ক্যারিয়ারের এই দীর্ঘ পথচলায় আমার সব সতীর্থ, সব কোচ, বিসিবির কর্মকর্তাগণ, আমার পরিবার ও যারা আমার পাশে ছিলেন, নানাভাবে সহায়তা করেছেন, ভরসা রেখেছেন এবং আমার ভক্ত-সমর্থক, বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনুসারী, সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। আপনাদের সবার অবদান ও ভালোবাসায় আমি চেষ্টা করেছি সব সময় দেশের জন্য নিজের সবটুকু উজাড় করে দিতে।

তামিম ইকবাল বলেন, "আমাকে নিয়ে আর বেশি গুতাগুতি করবেন না, সামনে যারা ক্রিকেটার আসবেন তাদের ক্রিকেট ভালো খেলুক খারাপ খেলুক শুধু ক্রিকেট নিয়েই থাকবেন"।

আফগানিস্তানের বিপক্ষে গতকালকের ম্যাচটিই আমার ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ। এই মুহূর্ত থেকে আমি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানাচ্ছি। সিদ্ধান্তটি হুট করে নেওয়া নয়। অনেক দিন ধরেই আমি ভাবছিলাম। পরিবারের সঙ্গে কথাও বলেছি এটা নিয়ে।

তিনি আরো বলেন, আমি সব সময় বলেছি ক্রিকেট খেলেই বাবার স্বপ্ন পূরণ করেছি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে গিয়ে অনেক পরিস্থিতির মুখে পড়েছি, সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমার ছোট চাচার হাত ধরেই ক্রিকেটে এসেছি। যারা আমাকে এই পর্যায়ে আনতে ভূমিকা রেখেছেন, তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

এর আগে আফগানিস্তানের বিপক্ষে বুধবার অপ্রত্যাশিত হারের পর রাতে আচমকা সংবাদ সম্মেলনের ঘোষণা দেন টাইগারদের ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবাল।

এরই মধ্যে উঠে গুঞ্জন, অধিনায়কত্ব ছাড়ছেন তামিম ইকবাল। সেই গুঞ্জনই সত্য হলো। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলে দিয়েছেন এই বাঁ-হাতি ওপেনার।

সাম্প্রতিক সময়টাতে চোট নিয়ে বেশ ভুগছিলেন তামিম। চোটের কারণে গত ডিসেম্বরে ভারতের বিপক্ষে সিরিজে খেলতে পারেনি তিনি। পিঠের নিচের অংশের পুরনো ব্যথা মাথাচাড়া দেওয়ায় কিছুদিন আগে খেলতে পারেননি আফগানিস্তানের বিপক্ষে মিরপুর টেস্টে। চলতি ওয়ানডে সিরিজ শুরুর আগের দিনও তিনি জানান যে, শতভাগ ফিট নন। প্রথম ম্যাচ খেলার পর অবস্থা বুঝে সিদ্ধান্ত নেবেন। শেষ পর্যন্ত তার সেই সিদ্ধান্ত চোট-টোটের সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছে গেল ক্যারিয়ারের শেষ বিন্দুতে।

২০০৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হারারেতে ওডিআই ম্যাচ দিয়ে অভিষেক হয় তার। ২০২০ সালে ওয়ানডে দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পান তিনি। চাচা আকরাম খান ও বড় ভাই নাফিস ইকবালকে অনুসরণ করেই তিনি পা রাখেন ক্রিকেটের পথে। বয়সভিত্তিক ক্রিকেট ও ঘরোয়া ক্রিকেটে আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের ঝড় তুলে ১৮ ছুঁইছুঁই বয়সেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়ে যায় ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে। স্রেফ চার ওয়ানডের অভিজ্ঞতায় খেলতে যান বিশ্বকাপে খেলতে নেমে প্রথম ম্যাচেই ভারতের বিপক্ষে স্মরণীয় এক জয়ে দাপুটে ফিফটি করে নজর কাড়েন ক্রিকেট বিশ্বের।

এরপর নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ক্রমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন দেশের সফলতম ব্যাটসম্যান হিসেবে। বাংলাদেশের ব্যাটিং রেকর্ডের অনেকগুলোই নিজের করে নেন তিনি। বাংলাদেশের ক্রিকেটে অনেক ‘প্রথম’ কিছুর জন্ম হয় তার হাত ধরে।

বিদায় বেলায় তার নামের পাশে ৭০ টেস্টে ৩৮.৮৯ গড়ে রান ৫ হাজার ১৩৪। সেঞ্চুরি ১০টি, ফিফটি ৩১টি। টেস্টে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান ও সেঞ্চুরি তার।

ওয়ানডে ২৪১টি খেলে ৩৬.৬২ গড়ে রান ৮ হাজার ৩১৩। ১৪ সেঞ্চুরির পাশে এখানে ফিফটি ৫৬টি। এই সংস্করণে দেশের হয়ে রান, সেঞ্চুরি, ফিফটি, সবকিছুতেই তিনি সবার ওপরে।

৭৪ ম্যাচে ১ হাজার ৭০১ রান নিয়ে তিনি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিকে বিদায় বলেছেন গত জুলাইয়েই। এই সংস্করণে দেশের একমাত্র সেঞ্চুরিয়ান তিনি।

তিন সংস্করণ মিলিয়ে ১৫ হাজার রান করা দেশের একমাত্র ব্যাটসম্যান তিনি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার সেঞ্চুরি ২৫টি। বাংলাদেশের হয়ে ২০ সেঞ্চুরিও নেই আর কারও।

২০১৭ সালে নিউজিল্যান্ড সফরে নিয়মিত অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমের চোটের কারণে ক্রাইস্টচার্চ টেস্টে নেতৃত্ব দিয়ে দেশের হয়ে প্রথম অধিনায়কত্বের স্বাদ পান তামিম। ২০১৯ বিশ্বকাপের পরপর শ্রীলঙ্কা সফরে তিন ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দেন তিনি মাশরাফি বিন মুর্তজার চোটে পড়ায়। ২০২০ সালে মাশরাফি নেতৃত্ব ছাড়ার পর ওয়ানডে দলের নিয়মিত অধিনায়কের দায়িত্বও পান তিনিই।

সব মিলিয়ে ৩৭টি ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি, জয়ের দেখা পেয়েছেন ২১টিতে। অন্তত ৫টি ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দেওয়া ক্রিকেটারদের মধ্যে সাফল্যের শতকরা হারে বাংলাদেশের সফলতম অধিনায়ক তিনিই।

বর্ণাঢ্য এই ক্যারিয়ারে নিশ্চিতভাবেই একটি বড় আক্ষেপ হয়ে থাকবে বিশ্বকাপ। চারটি ওয়ানডে বিশ্বকাপে ২৯ ম্যাচ খেলে তার সেঞ্চুরি নেই। চারটি ফিফটিতে ৭১৮ রান করেছেন কেবল ২৪.৭৫ গড়ে। ২০১৫ বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ৩১৯ রান তাড়ায় ৯৫ রানের ইনিংসটিই বিশ্বকাপে তার ক্যারিয়ার।

এবারের বিশ্বকাপে সেই আক্ষেপ ঘোচানের হাতছানি ছিল ব্যাটিংয়ে ও নেতৃত্বে। কিন্তু থমকে গেলেন তিনি নিজেই।

তার বিদায়ে শেষ হয়ে গেল বাংলাদেশ ক্রিকেটের একটি অধ্যায়েরও। এদেশের ক্রিকেটে মাঠ থেকে বিদায় নিতে না পারা গ্রেটদের তালিকাও এতে দীর্ঘ হলো আরেকটু।