মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে প্রশাসনের আরো কঠোর নজরদারি প্রয়োজন

Posted on April 3, 2021

সম্পাদকীয় : করোনাভাইরাস মহামারি মানুষের জীবনকে যেমন বিপর্যস্ত করেছে তেমনি আচার-আচরণেও পরিবর্তন এনেছে অনেক। করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর থেকে বাংলাদেশে সবচেয়ে প্রথম যে জিনিসটা প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে সেটা হল মাস্ক। বাংলাদেশের বড় শহরগুলো বিশেষ করে ঢাকায়, প্রায়ই বায়ু দূষণের মাত্রা চরমে পৌঁছালেও আগে মানুষকে মাস্ক পরতে দেখা যায়নি। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারি ঘোষণা করার পর মানুষ মাস্ক পরা শুরু করে।  সম্প্রতি মাস্ক ব্যবহারে অনীহা দেখা গেছে বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে। এজন্য স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে প্রশাসনের নজরদারি কমে যাওয়াকে দায়ী করছেন অনেকে। বিশেষ করে বিপণিবিতানগুলোতে ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে কমে গেছে মাস্ক ব্যবহারের প্রবণতা। কিন্তু জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘরের বাইরে মাস্ক ব্যবহার করলে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ ছড়ানোর শঙ্কা কমে যায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ। তাই মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে প্রশাসনের আরো কঠোর হওয়া দরকার।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ভ্যাকসিন বা টিকা আসার আগে মাস্ককেই প্রধান অস্ত্র হিসেবে দেখছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা। তাই সংক্রমণ ঠেকাতে মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করার কথা বারবার বলে আসছেন তারা।

যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের (সিডিসি) পরিচালক রবার্ট রেডফিল্ড সম্প্রতি এ প্রসঙ্গে বলেন, কোভিডের বিস্তার প্রতিরোধে ভ্যাকসিনের চেয়েও শক্তিশালী সুরক্ষা দেবে মাস্ক। তিনি বলেন, তাদের কাছে বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ রয়েছে যে, করোনায় মাস্কই সবচেয়ে ভালো সুরক্ষা দিচ্ছে।

দেশে যারা এখনো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন তাদেরও অনেকে মনে করছেন যে, টিকা দেওয়ার পর আর মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার দরকার হবে না। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকা নেওয়াটাই নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকার একমাত্র নিশ্চয়তা নয়। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘টিকা দেওয়ার পরও স্বাস্থ্যবিধি মানার বাধ্যবাধকতা এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। কারণ টিকা নেওয়ার পর কোভিডে আক্রান্ত না হলেও অন্যকে সংক্রমিত করার ক্ষমতা থাকবে। টিকা নেওয়া ব্যক্তির শরীরে কোভিড-১৯ প্রবেশ করলে তা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার সঙ্গে লড়াই করবে পরাজিত হবে, কিন্তু ওই সময় তার হাঁচি-কাশি-স্পর্শে অন্যকে আক্রান্ত করবে।’

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে শতভাগ কার্যকর কোনো টিকা পাওয়া যায়নি। সর্বোচ্চ ৯০ ভাগের তথ্য জানা যাচ্ছে। টিকা নেওয়ার পরও বাকি ১০ ভাগ রোগ ছড়াবে। দেশের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষ টিকার আওতায় এলেই সুরক্ষাবলয় তৈরি হওয়ার কথা বলা যাবে। তিনি বলেন, টিকা নেওয়ার পরও সবাইকে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। কারণ একজন টিকা নেওয়ার পরও ক্লিনিক্যাল ও ফিজিক্যালি রোগ ছড়াতে পারে বা করোনায় আক্রান্ত হতে পারে। তিনি আরো বলেন, টিকা রোগের তীব্রতা কমাবে। কোভিড-১৯ আক্রান্ত হলেও তাকে হাসপাতালের যেতে হবে না, কিন্তু অন্যদের মধ্যে রোগ ছড়াবে ঠিকই।

গত বছরের জুন মাসে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাইরে গেলে যেমন মাস্ক পরা বাধ্যতামুলক তেমনি বাড়িতেও মাস্ক পরা ভালো। এতে করে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কোভিড সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া ঠেকানো সম্ভব। তাই গবেষকরা বাড়িতেও মাস্ক পরে থাকার উপদেশ দিয়েছেন।

স্বাস্থ্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক সাময়িকী ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল গ্লোবাল হেলথ-এ প্রকাশিত ওই গবেষণায় দেখা গেছে, বাসাবাড়িতে মাস্ক পরলে ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়ানো ৭৯ শতাংশ ঠেকানো সম্ভব। তবে প্রথম কোনো সংক্রমিত ব্যক্তির উপসর্গ দেখা দেওয়ার আগেই পরিবারের সদস্যরা মাস্ক পরা শুরু করলেই কেবল এই ফল পাওয়া যাবে। জীবাণুনাশক দিয়ে বারবার ঘর পরিষ্কার করলে প্রায় সমান ফল পাওয়া যাবে। এই উপায় মানলে সংক্রমণ ছড়ানো ঠেকানো যাবে ৭৭ শতাংশ।

অপর এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাস্ক না পরা থাকলে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি ২৩ গুণ বেড়ে যায়। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির এক গবেষণায় দেখা গেছে, হাঁচি বা কাশির পর বাতাসে ড্রপলেট ছড়ানোর মাধ্যমে ‘কফ ক্লাউড’ তৈরি হয় এবং তা ৫ থেকে ৮ সেকেন্ড থাকে। মাস্ক পরা না থাকলে এর মাধ্যমে কোভিড সংক্রমণ দ্রুত ছড়িতে পড়তে পারে। তবে ওই সময়ের পর আর বাতাসে ভাসমান অবস্থায় থাকতে পারে না ড্রপলেট।

দেশে করোনাভাইরাসের শুরুতে মাস্কের চাহিদা ও দাম বেশি থাকলেও এখন চিত্র পুরো উল্টো। মাস্ক ব্যবহারে সবচেয়ে বেশি অনীহা দেখা গেছে রাজধানীর বিপণিবিতানসহ যানবাহনগুলোতে। মানা হচ্ছে না কোনো সামাজিক দূরত্বও।

"সার্জিকাল মাস্ক আগে ৫ টাকায় বিক্রি হতো কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর প্রথম কয়েক মাস ৫০ টাকায় বিক্রি হতো প্রতি পিস। প্রচুর চাহিদা ও পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় নামে-বেনামে ব্যক্তি-কোম্পানি  তৈরি করছে মাস্ক এবং ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে বিক্রি করছেন। সাধারণ মানুষ এসব মাস্ক পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, আর ভাবছেন তিনি করোনা থেকে মুক্তি পেয়ে গেলেন। কিন্তু বাস্তবে তা পুরোপুরি সটিক নয়। বর্তমানে মাস্কের দাম অনেকটা আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে। মানুষের জীবনে মাস্কের ব্যবহার এখন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। বিশ্বের বহু দেশেই সংক্রমণ ঠেকানোর একটি জনপ্রিয় ব্যবস্থা হচ্ছে মাস্ক ব্যবহার। অবশ্য বায়ুবাহিত ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে এই মাস্ক কতটা কার্যকর সে ব্যাপারে যথেষ্টই সংশয়ে আছেন ভাইরাস বিশেষজ্ঞরা, যাদেরকে বলা হয় ভাইরোলজিস্ট।

আমাদের দেশে ৩ প্রকার মাস্ক পাওয়া যায়। যেমন-

1.N95 রেসপাইরেটর বা মাস্ক 2.সার্জিক্যাল মাস্ক 3.কাপড়ের সাধারণ মাস্ক

N95 মাস্ক বায়ুবাহিত কণা ও দূষিত তরল থেকে রক্ষা করতে ব্যবহৃত হয়। স্বাস্থ্যকর্মী, বিশেষ করে যাঁরা সংক্রামক রোগ বা করোনা চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন, তাঁদের জন্য তৈরি হয় N95 মাস্ক । করোনাভাইরাসসহ (কোভিড-১৯) শ্বাসজনিত রোগ থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য সাধারণ মানুষের N95 মাস্ক পরিধান করাকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সিডিসি সুপারিশ করে না । সাধারণ মানুষের জন্য, N95 মাস্ক পরিধানের কোনো অতিরিক্ত স্বাস্থ্য সুবিধা নেই এবং কোভিড-১৯ থেকে তাৎক্ষণিক খুব সুবিধা দেবে তা-ও নয়।

2.সার্জিক্যাল মাস্কগুলো লুজ ফিটিং ডিসপোজেবল মাস্ক, যা মুখ ও নাকের মধ্যে বাধা তৈরি করার জন্য কাজ করে। অপারেশন থিয়েটার বা বিজ্ঞানাগারে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের জন্য এ জাতীয় মাস্ক সুপারিশ করা হয়। এ ধরনের মাস্ক ব্যবহার করা হয় যাতে তাঁর নাক ও মুখ থেকে জীবাণু বের হয়ে কন্টামিনেশন ঘটাতে না পারে। আলগা-ফিটিং থাকার কারণে সার্জিক্যাল মাস্কগুলো হাঁচি-কাশি থেকে বের হওয়া ছোট ছোট বায়ুবাহিত কণা বা জীবাণুকে আটকাতে পারে না। এগুলো পুনরায় ব্যবহার বা একাধিক ব্যক্তি ব্যবহার করা যাবে না। সুস্থ লোকের জন্য সার্জিক্যাল মাস্ক পরার পরামর্শ সিডিসি দেয় না।

3.পুনর্ব্যবহারযোগ্য কাপড়ের মাস্কগুলোকে ডাস্ট বা ধূলি-মাস্ক বলা হয়। এ জাতীয় মাস্ক করোনাভাইরাস বা অন্য ক্ষুদ্র জীবাণু থেকে সুরক্ষা দিতে পারে না। এ জাতীয় মাস্ক বাতাসের ধূলিকণা থেকে হয়তো রক্ষা করতে সক্ষম, তবে পুনর্ব্যবহারযোগ্য কাপড়ের মাস্ক ঠিকমতো পরিষ্কার না করলে এটির মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি থেকে যায়। যাঁরা এ জাতীয় মাস্ক ব্যবহার করেন, তাঁরা নিয়মিত ও ঠিকভাবে পরিষ্কার করে তারপর ব্যবহার করবেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সিডিসি জানিয়েছে, সুস্থ লোক, যাঁরা অসুস্থ ব্যক্তির যত্ন নিচ্ছেন না, তাঁদের করোনা প্রতিরোধের জন্য মাস্ক পরার দরকার নেই । সংস্থাগুলোর মতে, নিম্মলিখিত লোকদের মাস্ক ব্যবহার করা উচিত—

সংক্রমণ আটকানোর জন্য কাশি ও শ্বাসকষ্ট বা কোভিড-১৯ আছে বা সন্দেহভাজন এমন লোক

যারা এ জাতীয় রোগী পরিবহন, সেবা, চিকিৎসা অথবা তাদের কাছাকাছি কাজ করছেন

স্বাস্থ্যকর্মী, বিশেষ করে যাঁরা করোনা চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন, তাঁদের N95 মাস্ক পরা উচিত

কিছু কিছু দেশ সাধারণ জনগণকে মাস্ক পরার ব্যাপারে উৎসাহিত করছেন। যদি পর্যাপ্ত উৎপাদন থাকে, তাহলে ব্যবহার করতে পারেন। তবে একটা বিষয় বিশেষভাবে খেয়াল রাখবেন, মাস্ক পরে আপনি নিশ্চিন্তে ঘোরাফেরা করবেন না এবং ভাববেন না যে আপনি মুক্ত আছেন বা মুক্ত থাকবেন। ব্যাপারটি যেন এমন না হয়, আপনি অস্ত্র নিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুরছেন শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য। কিন্তু শত্রু যখন আঘাত করল, তখন আপনার অস্ত্রটি তাক করার সময়ই পেলেন না। তাই মাস্ক ব্যবহার করার চেয়ে খুব প্রয়োজন না হলে ঘরে থাকুন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন, হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মেনে চলুন, নিয়মিত আপনার হাতটি পরিষ্কার রাখুন।