ইনসাইডার ট্রেডিং নীতিমালা করেনি তালিকাভূক্ত এনবিএফআই ২২ কোম্পানি

Posted on June 1, 2023

তানভীনা সাফরিন : গত ৩০ জানুয়ারি ২০২৩ তারিখে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশন এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশন (সুবিধাভোগী ব্যবসা নিষিদ্ধকরণ বিধিমালা, ২০২২ জারি করে। যাতে সুবিধাভোগী ব্যবসা বা ইনসাইডার ট্রেডিং অর্থাৎ অপ্রকাশিত মূল্য সংবেদনশীল তথ্যের ভিত্তিতে কোন সুবিধাভোগী কর্তৃক কোন শেয়ার বা ফান্ড ক্রয় বা বিক্রয় করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

বিধিমালায় আরও বলা হয়েছে, তালিকাভূক্ত কোম্পানি বা ফান্ড বা সিকিউরিটির ইস্যুয়ার বা ফান্ডের ব্যবস্থাপক বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ তথ্য এবং মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ নীতিমালা (principles on Disclosure of Material information and Price sensitive information) প্রস্তত করবে এবং বিধিমালা সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হবার তারিখ হতে ৩ মাসের মধ্যে অর্থাৎ ৩০ এপ্রিলের মধ্যে উক্ত নীতিমালা নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবে। পাশাপাশি তালিকাভূক্ত সিকিউরিটির ইস্যুয়ার ও ফান্ডের ব্যবস্থাপক কমপক্ষে বিগত ৩ বছরের সকল প্রকাশিত মূল্য সংবেদনশীল তথ্য (পিএসআই) ও (মেটেরিয়াল ইনফরমেশন) নিজস্ব ওয়েবসাইটে সংরক্ষণ করবে। এবং উক্ত তথ্য সংশ্লিষ্ট স্টক একচেঞ্জ ও কমিশনকে সরবরাহ করবে। কোন সুবিধাভোগী এ বিধান লঙ্ঘন করলে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড একচেঞ্জ অর্ডিনেন্স, ১৯৬৯ এর সেকশন ১৭ এর বিধান মোতাবেক প্রতারণামূলক কর্মকান্ড হিসেবে গণ্য হবে এবং তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত আর্থিকখাতের মোট ২৩টি কোম্পানি রয়েছে। কোম্পানিগুলোর মধ্যে ১টি কোম্পানি ছাড়া বাকী ২২টি কোম্পানির ওয়েবসাইটে ইনসাইডার ট্রেডিং নীতিমালা পরিপালন করা হয়নি। যাদের মধ্যে ব্যতিক্রম শুধু ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিং ফাইন্যান্স লিমিটেড। অর্থাৎ আর্থিকখাতের ২২ কোম্পানি এখনও এ নীতিমালা পরিপালন করেনি।

আর্থিকখাতের কোম্পানিগুলোর ওয়েবসাইট পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, তাদের মধ্যে ফারইস্ট ফাইন্যান্স এবং প্রিমিয়ার লিজিং কোম্পানির ওয়েবসাইট ওপেন হয় না। অন্যদিকে ইউনাইটেড ফাইন্যান্স এর ওয়েবসাইটে শুধু মেটেরিয়াল ইনফরমেশন লেখা আছে কিন্তু তাতে কোন তথ্য দেয়া নেই। আর পিপলস লিজিং এন্ড ফাইন্যান্স সার্ভিসেস এর লেনদেন বন্ধ রয়েছে ২০১৯ সাল থেকে।

এছাড়া বে লিজিং, বিডি ফাইন্যান্স, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স, এফএএস ফাইন্যান্স, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স, আইসিবি, আইডিএলসি, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, আইপিডিসি ফাইন্যান্স, ইসলামিক ফাইন্যান্স, লংকাবাংলা ফাইন্যান্স, মাইডাস ফাইন্যান্স, ন্যাশনাল হাউজিং, ফিনিক্স ফাইন্যান্স, প্রাইম ফাইন্যান্স, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল এবং উত্তরা ফাইন্যান্স বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) বেধে দেয়া ৩ মাস (অর্থাৎ ৩০ এপ্রিল) শেষ হলেও কোম্পানিগুলোর ওয়েবসাইটে ইনসাইডার ট্রেডিং নীতিমালা প্রকাশ করেনি।

এ বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক সভাপতি শাকিল রিজভী কর্পোরেট সংবাদকে বলেন, এটা বিএসইসি ইনসাইডার ট্রেডিং রোধে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে করেছে। কোম্পানিগুলো যদি ইনসাইডার ট্রেডিং এ সরাসরি যুক্ত না থাকে তাহলে তো ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের নীতিমালা করে ওয়েবসাইডে দিতে কোন বাধা নাই।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশনের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম কর্পোরেট সংবাদকে বলেন, এ বিষয়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত কোম্পানিগুলোর শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব পাবলিক লিস্টেড কোম্পানি (বিএপিএলসি) এর পক্ষ থেকে আরো ৩ মাস সময় চেয়ে আমাদের কাছে চিঠি দিয়েছে।

এ বিষয়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত কোম্পানিগুলোর শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব পাবলিক লিস্টেড কোম্পানি (বিএপিএলসি) এর সেক্রেটারি জেনারেল মো: আমজাদ হোসেন কর্পোরেট সংবাদকে বলেন, আমরা এ বিষয়ে বিএসইসির কাছে গত ১০ এপ্রিল ৩ মাসের সময় চেয়ে চিঠি দিয়েছি। তারা বিষয়টি বিবেচনা করে দেখবে বলেছে।

এদিকে ইনসাইডার ট্রেডিং এর কারণে পুঁজিবাজারে প্রায়ই দেখা যায়, কোম্পানিগুলোর মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশের আগে আগে শেয়ারদর অস্বাভাবিক হারে বেড়ে বা কমে যাচ্ছে। কোম্পানির পক্ষ থেকে ইতিবাচক ঘোষণা আসার আগে দর বেড়ে যায়, আর ‘খারাপ তথ্য’ থাকলে শেয়ারদর কমে যায়। এ প্রক্রিয়ায় এক শ্রেণির মানুষ বিপুল পরিমাণ অর্থ কামিয়ে নিচ্ছে। তারা কম দামের শেয়ার অন্যদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করে দিচ্ছে। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ‘আরও বাড়বে’ ভেবে তা কিনে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছে। তাই শেয়ার লেনদেনের ক্ষেত্রে কোনো ইনসাইডার ট্রেডিং বা সুবিধাভোগী লেনদেনের ঘটনা ঘটেছে কি না, তা খুঁজে বের করে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সুবিধাভোগী লেনদেন বা ইনসাইডার ট্রেডিং বন্ধে কঠোর আইন না থাকায় আস্থার সংকট কাটেনি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে উদ্যোক্তা, ব্যবস্থাপক ও নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠানের (অডিট ফার্ম) মতো কোম্পানির ভেতরের লোকেরাই পুঁজিবাজারের অনিয়ম ‘সবচেয়ে বেশি’ করেন, কারণ তারা আগে থেকেই তথ্যগুলো জানেন। তাই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সিঙ্গাপুরের উদাহরণ অনুসরণ করে বাংলাদেশে ‘ইনসাইডার ট্রেডিং’ বন্ধে আরও কঠোর আইন করার ওপর জোর দিতে হবে। এই ইনসাইডারদের তথ্যের ভিত্তিতে শেয়ারবাজারে অনেক অনিয়মের ঘটনা ঘটে। ইনসাইডার ট্রেডিং যারা করে, তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনতে পারলে পুঁজিবাজারের উপর মানুষের আস্থা আরও বাড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, বৃহস্পতিবার (১ জুন, ২০২৩) বেলা সাড়ে ১২টায় ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্সুরেন্সের স্ক্রিনে ৬৪ লাখ ৩৩ হাজার ৯৩৭টি শেয়ার ক্রয়ের আবেদন থাকলেও বিক্রেতার ঘর শূন্য ছিল। আলোচ্য সময়ে কোম্পানিটির শেয়ার সর্বশেষ ৪৪ টাকা ৯০ পয়সা দরে লেনদেন হয়। আগামী ৫ জুন কোম্পানিটির বোর্ড সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় কোম্পানিটির ৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ সমাপ্ত প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করা হবে। সভা থেকে প্রথমবারের মত শেয়ারহোল্ডারদের জন্য লভ্যাংশের ঘোষণা আসতে পারে। আর এ খবরে আজ কোম্পানিটি হল্টেড হয়। আজ টপটেন গেইনার তালিকার তৃতীয় স্থানে অবস্থান করছে ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। আজ শেয়ারটির দর বেড়েছে ৪ টাকা বা ৯.৭৮ শতাংশ।

এছাড়া আজ বেলা ১২টা ৩৫ মিনিট পর্যন্ত মেঘনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের স্ক্রিনে ১ লাখ ৫৪ হাজার ৪৪৪টি শেয়ার কেনার আবেদন থাকলেও বিক্রেতার ঘর শূন্য ছিল।ফলে কোম্পানিটি হল্টেড হয়। আলোচ্য সময়ে কোম্পানিটির শেয়ার সর্বশেষ ৯৩ টাকা ৮০ পয়সা দরে লেনদেন হয়। আজ টপটেন গেইনার বা দর বাড়ার শীর্ষে রয়েছে মেঘনা লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড। আজ শেয়ারটির দর ৮ টাকা ৫০ পয়সা বা ৯.৯৬ শতাংশ বেড়েছে। এদিন শেয়ারটি সর্বশেষ ৯৩ টাকা ৮০ পয়সা দরে লেনদেন হয়।

তথ্য অনুযায়ী, কোম্পানিটি ৩ হাজার ৩৩০ বারে ৩৬ লাখ ২ হাজার ২৭৫টি শেয়ার লেনদেন করে। যার বাজার মূল্য ৩২ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। এদিকে প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্স ও নাভানা ফার্মা লিমিটেডের শেয়ার দর অস্বাভাবিকভাবে বাড়ার কারণে ডিএসই নোটিস পাঠায়। বাজার পর্য ক্ষণে দেখা যায়, ডিএসইতে গত ২২ মে প্রগতি লাইফের শেয়ার দর ছিল ১১৩ টাকা ৩০ পয়সা। ৩১ মে কোম্পানিটির শেয়ার দর ১৩৬ টাকা ৩০ পয়সায় উন্নীত হয়। একই সময়ে নাভানা ফার্মার শেয়ার গত ১৫ মে ৮০ টাকা ৫০ পয়সা ছিল। আর ৩১ মে ১০৭ টাকা ১০ পয়সায় উন্নীত হয়।

সম্প্রতি ইমাম বাটন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের শেয়ার দর অস্বাভাবিকভাবে বাড়ার কারণে ডিএসই নোটিস পাঠায়। প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে কোম্পানিটির কারখানা বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে কোম্পানিটির বন্ধ কারখানা চালুরও কোনো সম্ভবনা নেই। বাজার পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ডিএসইতে গত ২২ মে কোম্পানিটির শেয়ার দর ছিল ৮২ টাকা ৮০ পয়সা। ৩১ মে কোম্পানিটির শেয়ার দর ১১৬ টাকা উন্নীত হয়। এই দর বাড়াকে অস্বাভাবিক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির সাবেক অধ্যাপক আবু আহমেদ মনে করেন, কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকরা নিজেরাই বা কোম্পানিরই কেউ না কেউ এই ‘ইনসাইডার’ তথ্য ফাঁস করেন। পুঁজিবাজারে এ বিষয়টি সবারই জানা। এভাবে প্রতিবার প্রান্তিক প্রতিবেদন প্রকাশের আগে বিপুল পরিমাণ টাকা কামানোর সুযোগের কারণেই দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগে যায় না বিনিয়োগকারীরা।