৪ ধাপে তালিকাভুক্ত কোম্পানির এজিএম হওয়া প্রয়োজন

Posted on February 20, 2022

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত একাধিক কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) একদিনে অনুষ্ঠিত হওয়ার রেওয়াজ রয়েছে।একদিনে এবং একই সময় একাধিক কোম্পানির এজিএম হওয়ায় ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করছেন বিনিয়োগকারীরা। বছরে একবার সুযোগ হয় কোম্পানির সাথে সব বিষয়ে আলোচনা করার। কিন্তু একই সময় বিভিন্ন স্থানে একাধিক কোম্পানির এজিএম হওয়ায় এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে হাজার হাজার বিনিয়োগকারী। একদিনে ও একই সময়ে যখন একাধিক কোম্পানির এজিএম হয় তখন সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা সব এজিএমে অংশগ্রহণ করতে পারেন না।

এ কারনে বিনিয়োগকারীদের সম্মতি ছাড়াই নিজেদের সুবিধামত এজেন্ডা পাশ করে নিচ্ছে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো। যদি সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারীরা এজিএমে অংশগ্রহণ করতে পারেন- তাহলে তাদের সাথে সরাসরি দেখা হবে মালিকপক্ষের। অনেক বিনিয়োগকারী আছে যাদের একাধিক কোম্পানির শেয়ার আছে। তারা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে পারে, যা কোম্পানির ভিত মজবুত করতে সহায়ক হবে।

নিয়মানুসারে এজিএমে ঘোষিত লভ্যাংশ শেয়ারহোল্ডারদের সম্মতিক্রমে ভোটের মাধ্যমে অনুমোদন করা হয়। কিন্তু বর্তমান এজিএম সিস্টেমের কারনে বিনিয়োগকারীদের অনুপস্থিতির সুযোগে কোম্পানিগুলোর জবাবদিহিতা থাকছেনা। এতে ক্রমেই তারা সেচ্ছাচারি হয়ে ওঠছে । কোনো আইন-কানুন সঠিকভাবে পালনও করছে না পর্ষদ। প্রকৃত বিনিয়োগকারীদের অনুপস্থিতির কারণে সব কিছুর মধ্যে অস্বচ্ছতা রয়ে যাচ্ছে।

পর্যালচনায় দেখা গেছে, গত ডিসেম্বর মাসেই অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৭৩টি কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভা। এর মধ্যে গত ২৩ ডিসেম্বর ৩০টি, ৩০ ডিসেম্বর ২৫টি, ২৭ ডিসেম্বর ১৯টি, ২৬ ডিসেম্বর ১৩টি, ২৮ ডিসেম্বর ১৩টি ২৯ ডিসেম্বর ১১টি, ১৫ ডিসেম্বর ১০টি, ২২ ডিসেম্বর ১০টি, ১৪ ডিসেম্বর ৬টি, ১৯ ডিসেম্বর ৫টি, ২০ ডিসেম্বর ৭টি, ২১ ডিসেম্বর ৪টি, ২৫ ডিসেম্বর ৪টি, ১১ ডিসেম্বর ৩টি, ১২ ডিসেম্বর ৪টি এবং ১৩ ডিসেম্বর ৩টি কোম্পানির এজিএম অনুষ্ঠিত হয়েছে।

এখন ধরা যাক, যেদিন ৩০টি কোম্পানির এজিএম অনুষ্ঠিত হচ্ছে তার মধ্যে একেক জন বিনিয়োগকারীর শেয়ার রয়েছে ১০টি বা সবগুলো কোম্পানির। এমতাবস্থায় ওই বিনিয়োগকারী কিভাবে এজিএমে তার মতামত জানাবে? এজিএমের এ সমস্যা নিয়ে বাজার বিশ্লেষকদের মতামত হলো, একদিনে একাধিক কোম্পানির এজিএম অনুষ্ঠিত হলেও যেন একটা সকালে আর একটা বিকালে হয়। আর একদিনে যেন ৫/৬টার বেশি এজিএম না হয় তার জন্য বাজার সংশ্লিষ্টদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

কোম্পানিগুলোরও উপায় নেই এজিএম না করার। ১০ মার্চ ২০২১, বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন কোম্পানি পুঁজিবাজারে সকল কোম্পানির হাইব্রিড পদ্ধতিতে বা অনলাইন ও সশরীরে উপস্থিতি উভয় পদ্ধতির সংমিশ্রনে থার্ডপাটি আইটি প্লাটফর্মের মাধ্যমে একজন কর্পোরেট প্রফেশনাল স্কুটিনাইজার বা অবজার্ভারের উপস্থিতিতে এজিএম করার নির্দেশনা জারি করেছে। যেখানে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের সাথে সাধারণ শেয়ারহোল্ডার, একটি থার্ডপাটি আইটি প্লাটফর্ম ও একজন পেশাদার কর্পোরেট প্রফেশনাল এর উপস্থিতিতে এজিএম সম্পন্ন করার বিধান করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে এজিএমে অনলাইন প্লাটফর্মের সার্ভিস দেওয়ার জন্য ৬/৭ টি থার্ডপার্টি আইটি ফার্ম এজিএম সার্ভিস প্রভাইড করছে। আবার একই সাথে শতাধিক কর্পোরেট প্রফেশনাল এজিএমে অবজার্ভার হিসেবে উপস্থিত থেকে এজিএম সম্পর্কে ইন্ডিপেন্ডেন্ট রিপোর্ট দিচ্ছে। যা এজিএম পরবর্তী ৪৮ ঘন্টার মধ্যে বিএসইসিতে জমা করার বিধান করা হয়েছে।

দিনের পর দিন শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাও একদিনে একাধিক কোম্পানির এজিএমে বাঁধাও দিতে পারছে না। তাহলে দেখা যাচ্ছে, সার্বিকভাবে একদিনে অনেকগুলো কোম্পানির এজিএম হলে এমনকি একই সময়ে একাধিক কোম্পানির এজিএমের সময় নির্ধারিত থাকলে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সাধারণ শেয়ারহোল্ডার, থার্ডপাটি আইটি ফার্ম এর সার্ভিস ইন্ডিপেন্ডেন্ট পেশাদার অবজার্ভ ও স্টক এক্সচেঞ্জের পক্ষে একই সাথে ৩০/৩৫ টি এজিএমে উপস্থিত থাকা সম্ভব হয় না। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা চাইলে এর পরিবর্তন করতে পারে, যেন এক দিনে একাধিক কোম্পানির এজিএম অনুষ্ঠিত না হয়। বিনিয়োগকারিরা যেন সব কোম্পানির এজিএমে অংশগ্রহণ করতে পারে সে ব্যাপারে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিএসইসির হস্তক্ষেপ কামনা করেন সাধারণ শেয়ারহোল্ডারগন।

শেয়ারবাজারে কর্পোরেট বন্ড, ডিবেঞ্চার এবং ট্রেজারি বন্ড ছাড়া ৪১৭টি কোম্পানি রয়েছে। এই ৪১৭টি তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে ৪ ভাগে ভাগ করে বছরের ৪ ধাপে এজিএম করার নিয়ম করা যেতে পারে। দেখা যাবে প্রতি ৩ মাস অন্তর ১০০টি বা তারচেয়ে কম বেশি এজিএম করতে পারবে কোম্পানিগুলো। এতে সারা বছরই কোন না কোন কোম্পানির এজিএম অনুষ্ঠিত হবে। এর ফলে বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে।

এক্ষেত্রে ব্যাংক-বীমা-আর্থিক খাত মিলে ১০৭টি কোম্পানির ক্লোজিং ডিসেম্বর করা যেতে পারে। এরপর প্রকৌশল ও বস্ত্র খাত মিলে মোট ১০০টি কোম্পানির ক্লোজিং ৩১ মার্চ করা যেতে পারে। মিচ্যুয়াল ফান্ড, ওষুধ ও রসায়ন এবং খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাত মিলে ৯৯টি কোম্পানির ক্লোজিং জুন মাসে করা যেতে পারে। আর বাকি ছোট ছোট খাতগুলোর মোট ১১১টি ক্লোজিং সেপ্টেম্বর করা যেতে পারে। এভাবে ক্লোজিং করা হলে কোম্পানিগুলোর মধ্যে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা বাড়বে। বিনিয়োগকারীরাও এজিএমে অংশগ্রহণ করে স্বাধীনভাবে মতামত প্রদান করতে পারবে এবং এতে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা হবে বলে মনে হয়।

ফলে ৪ ধাপে এজিএম করলে সবার জন্যই এজিএমে উপস্থিত থাকা, মত বিনিময় করা ও সার্ভিস প্রোভাইড করা সহজতর হয়। আবার এতগুলো তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে আর্থিক নিরিক্ষা করছে তালিকাভুক্ত ৩৮/৩৯ টি অডিট ফার্ম ফলে একটি অডিট ফার্ম তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানিকে অডিট করে থাকে বিধায় অডিট ফার্মের জন্য বর্তমান পদ্ধতিতে অডিট কাজ সম্পন্ন করতে কষ্টকর হয়ে যায়।

কিন্তু নির্ধারিত সময়ে এজিএম সম্পন্ন করার বর্তমান নিয়মের কারণে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষে সার্বিক ভাবে সম্ভব হয় না। ফলে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে কর্পোরেট সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। সুতরাং নির্দেশনা দিয়ে বসে থাকলেই তো হয় না নির্ধারিত সময়ে সকল কাজ সুষ্ঠভাবে সম্পূর্ণ করে পুঁজিবাজারে কর্পোরেট সু-শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়াটা জরুরি।

অতএব, সার্বিক বিবেচনায় বছরে ৪ ধাপে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির এজিএম হওয়া প্রয়োজন। এটা সময়ের দাবি, বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতি বিবেচনায় অত্যাবশ্যকও বটে। কাজেই পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রনকারী কর্তিপক্ষের নিকট বছরে ৪ ধাপে নতুন পদ্ধতিতে এজিএম করার জোর দাবি জানাচ্ছি।