দাঁড়ি কই! ডাক্তার ফেরদৌস খন্দকার

Posted on June 9, 2020

মুহাম্মদ সেলিম হক : তোমার দাঁড়ি কই? আক্কাস বুঝতে পারেনি স্কুল করার সাথে দাঁড়ির কী সম্পর্ক? কথাটি এলাকার চেয়ারম্যান খালেক মাতব্বর থেকে শুনে একেবারে লজ্জায় মুখ নিচু করে রাখলো আক্বাস।শহর থেকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছেলে আক্কাস এসেছে মহব্বতপুর গ্রামে। উদ্দেশ্য নিজ গ্রামে একটি স্কুল করবেন। সবাই সচেতন হবে। সবাই মানুষ হইবে।

তার উদ্যোগে গ্রামের সাধারণ মানুষ খুশি হলেও মাজারের খাদেম মজিদ আর খালেক মাতব্বরের বড়ই ভয় ছিলো। কারণ মানুষ শিক্ষিত হলে তাদের মাজার ব্যবসা আর সাধারণ মানুষকে ঠকনো বন্ধ হয়ে যাবে। তাই তারাই রাতে পরামর্শ করেন। সকালের বৈঠকে স্কুল করা পন্ড করতে হবে। দাঁড়ি না রাখার অযুহাতে আক্কাসকে স্কুল করতে দিলো না অপমানজনক ভাষা হজম করতে না পেরে সে যুবক গ্রাম ছাড়লো।

এ কাহিনী ছিলো কথা সাহিত্যিক “সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর “লালসালু উপন্যাসের। লালসালু’ মূলত একটি সামাজিক উপন্যাস। এর বিষয় যুগ-যুগ ধরে শেকড়গাড়া কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও ভীতির সঙ্গে সুস্থ জীবনাকাঙ্ক্ষার দ্বন্দ্ব। এর কাহিনী গড়ে উঠেছে মজিদ নামে এক স্বার্থান্বেষী,  ভণ্ড ধর্মব্যবসায়ীকে কেন্দ্র করে।

স্বার্থান্বেষণকারী আজ ঘরে ঘরে। ৮০ বছর আগের কাহিনীর প্রতিচ্ছবি আজ যেন করোনা কালে ডাক্তার ফেরদৌস খন্দকারের আমেরিকা থেকে আসা সেই আক্কাসের মতো হলো। নেপথ্য থেকে মজিদ-খালেক আড়াল থেকে মিথ্যা অপবাদ ছড়ালো খন্দকারের বিরুদ্ধে।

তবে ভাগ্যে ভালো আমাদের ডাক্তার ফেরদৌস যখন বিমানে তখন তার বিরুদ্ধে মিথ্যার গল্প শুরু হয়। মাঝখানে তিনি অজানাতে রইলো। আসার আগে জানলে হয়তো মন ভেঙ্গে যেতো। দেশে আসার পর জানতে পারল তাকে নিয়ে মিথ্যার ডালপালা গজালোর গল্প। করোনার শুরুতে তিনি সোশ্যাল মিডিয়াতে সরব ছিলো মানুষকে সাহস দিতে। দেশের ভয়াবহ অবস্থা দেখে বিপদ জেনে ও উড়াল দিলো আমেরিকা থেকে। যেখানে আমাদের কিছু ডাক্তার করোনার ভয়ে ঘর থেকে বের হয় না।

অক্সিজেনের অভাবে রোগীরা ছুঁটে চলে হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে এ যেন প্রতিদিনের ভয়াবহ চিত্র। সেখানে সুদূর আমেরিকা থেকে ডাক্তার ফেরদৌসের আগমন আমাদের সাহস বাড়াবে করোনার লড়াই-এ। জানি একজন “ফেরদৌস “করোনা সরাতে পারবে না। তবে দেশের কিছু ডাক্তারদের ঘর থেকে বের করতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

মন্দের মাঝে অনেকে আলোচিত হন, তারই সফল উদাহরণ ডাক্তার ফেরদৌস। পিছন থেকে যারা ছুরি মেরেছে, মিথ্যা চেতনায় লাগিয়ে অদ্ভুত গল্প বানালো। তাকে হেয় করতে চেয়েছিলো তারা আজ হতাশ। বিপরীতে তাহার পিছনের রাজনীতি সংগ্রামের রঙ্গিন পালক সবার হৃদয় মনিকোঠায়।

সেই লালসালু উপন্যাসের যুবকের মতো তিনি দেশ ছেড়ে পালাবেন না মজিদ আর খালেকের ভয়ে। ঘুরে দাড়াঁবে সাহসী মানুষের প্রেরণায়।

একটি নামে তাঁরে কত ভুগালো। আমাদের দেশে রাজনীতি -আর ধর্মীয় কারণে কিছু নাম মারাত্বক। এ নাম মানেই মন্দের নানান উদারহরণ। যেমন মীর জাফর, খন্দাকার মোস্তাক, উমিচাদঁ, জগৎশেঠ। ধর্মীয় ভাবে আবু লাহাব, আবু জাহেল, শায়বা আজর এ নামগুলো কেউ রাখেনা। ফেরদৌস নামের শেষে খন্দকারই কাল হলো। কিছু আবাল যাচাই-বাচাই না করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেবল কপি করে। এরাও সমাজের জন্য মারাত্মক। করোনার ভাইরাসের চেয়ে এরা কম না। এদের লাগাম টানতে হবে, সুস্থ্য সমাজ গড়তে হলে। শেক্সপিয়ার বলেছে সুন্দর নামকরণে কি আসে যায়, গোলাপকে তুমি যে নামে ডাকো না কেন সে কিন্তু সুবাস ঠিক দিবে। এখানে সুবাসের কারণে গোলাপ বিখ্যাত নামের কারণে নয়। তবে মাঝমাঝে কুৎসিত বস্তুকেও নামের কারণে ভালো লাগে। নামকরণে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তি রয়েছে।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ যখন লেখালেখি শুরু করেন, সে সময়টা ছিল ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণ। ঢাকা ও কলকাতার মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবন তখন নানা ঘাত-প্রতিঘাতে অস্থির ও চঞ্চল; নানা রকম সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ঘটনার আবর্তে মধ্যবিত্তের জীবন তখন বিচিত্রমুখী জটিলতায় বিপর্যস্ত।এমতাবস্থায় চেনা জগতকে বাদ দিয়ে একজন নবীন ওয়ালীউল্লাহ্ সাহিত্যকৃতির জন্য বেছে নিলেন মানবসুলভ দ্বন্দ্ব-ত্রুটি বিচ্যুতির মুখ্য প্রতিরূপ।

লেখক সাংবাদিক ও কলামিস্ট