দুবাই ফেরত জিতু মিয়া, আয়কর আইনে একজন বাড়ীওয়ালা !

Posted on May 14, 2020

এ.কে.এম শফিকুল ইসলাম : জিতু মিয়ার বাড়ী রাজবাড়ী জেলায়, পাংশা উপজেলায়, বাহাদুরপুরে, তিনি ২৫ বছর আগে বাবার কিছু জমি বিক্রয় করে দুবাই গিয়েছিলেন। লেখাপড়া তেমন জানতেন না, অষ্টম শ্রেনী পর্যন্ত পড়ছিলেন, দুবাইয়ে একটা কন্সটাকশন কোম্পানীতে শ্রমিক হিসাবে কাজ করতেন। ঐ সময়েই মিরপুরে ৩ কাঠা জমি রাখেন, তারপর বাবার সাহায্য নিয়ে মাঝে মাঝে ঢাকায় এসে আস্তে আস্তে বাড়ীর কাজ শুরু করেন, খুব কষ্টে করে কোন মতো ৫ তলা একটা বাড়ীর ফ্রেম দাড় করান। তারপর তিনি একেবারেই দুবাই থেকে চলে আসেন এবং আস্তে আস্তে বাড়ীর কাজ শেষ করেন। বাড়ীর ছোট বড় দিয়ে ১০টা ইউনিট হয়েছে, নিজেই বাড়ীর সব কাজ করেন, কোন দারোয়ান রাখেন নাই, সারা দিন বাড়ীর সামনে বসে থাকেন মোট কথা বাড়ীটাই তার সব।

একদিন আনুমানিক ১২টার সময় বাসার সামনে চেয়ারে বসে আছেন,  এমন সময় একজন অল্প বয়স্ক ভদ্রলোক এসে জিতু মিয়াকে জিঞ্জাসা করলেন এই বাড়ীর মালিক কে? আমি তার সাথে কথা বলব একটু জোড় দিযেই বললেন, জিতু মিয়া একটু ভিতু হয়ে বললেন “আমি”, ভদ্রলোকটি নিজের পরিচয় দিলেন, “আমি রফিকুল ইসলাম (রফিক), ট্যাক্স অফিস থেকে এসেছি” তখন জিতু মিয়া বাড়ীর আয়ের যে ট্যাক্স দেন সেই সকল কাগজপত্র দেখান, জিতু মিয়া একটু বিপাকে পড়ে গিয়ে বললেন, “স্যার কিছুই তো নাই”, স্যার বলার কারণ হলো উনিতো ট্যাক্স অফিস থেকে আসছেন তাই একটু বুদ্ধি করে জিতু মিয়া বললেন। রফিক স্যার জিতু মিয়াকে বুঝানোর চেষ্টা করলেন ইনকাম ট্যাক্স কি? অনেক বুঝানোর পর শেষ পর্যন্ত বললেন যে, আইনে কি আছে তা আগে শুনুন।

রফিক স্যার জিতু মিয়াকে আইনের কথা যা বললেন তা হলো, “আয়কর আইন ১৯৮৪ এর ধারা-২৪ উপ-ধারা (১) করদাতাকে তার মালিকানাধীন কোন সম্পত্তি, যা কোন ভবন, ফার্ণিচার, ফিকচার, ফিটিং ইত্যাদি ও তৎসংলগ্ন ভূমির সমন্বয়ে গঠিত উহার যে অংশ ঐ করদাতার নিজস্ব ব্যবসা বা পেশার জন্য ব্যবহার করে থাকে তা ব্যতীত অবশিষ্ট সম্পত্তি করদাতা বাণিজ্যিক বা আবাসিক যে কোন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে কোন আয় অর্জন করলে, তবে উক্ত সম্পত্তির বার্ষিক মূল্যের নিরিখে অর্জিত ঐরূপ আয়কে অধ্যাদেশের আওতার কর প্রদানের লক্ষ্যে কর নির্ধারণীর আওতাভুক্ত করতে হবে।

এই আয় থেকে উক্ত অধ্যাদেশের ধারা ২৫ অনুসারে খরচসমুহ বাদ দিয়ে আয় নির্ধারণ করা হয়। উক্ত ধারা অনুসারে অনুমোদনযোগ্য খরচগুলো (১) বাড়ীর সংস্কার, ভাড়া আদায়, পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন, বিদ্যুৎ বিল এবং দারোয়ান, নিরাপত্তা রক্ষী, পাম্প-চালক, লিফট-ম্যান ও কেয়ারটেকারের বেতন ইত্যাদি। আবাসিক ব্যবহারের জন্য ভাড়া দেওয়া হলে মোট ভাড়ার ২৫% অথবা বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য ভাড়া দেওয়া হলে মোট ভাড়ার ৩০%। (২) উক্ত সম্পত্তির ভূমির উপর ভুমি উন্নয়ন কর অথবা খাজনা বাবদ সরকারকে পরিশোধ করতে হয় এরূপ যেকোন পরিমান অর্থৎ (৩) সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির বীমা করা হলে তার বীমা কিস্তির (৪) উক্ত সম্পত্তির আংশিক বা সম্পূর্ন অংশ ভাড়া না হয় অর্থাৎ খালি থাকে তা বাদ দিয়ে হিসাব করতে পারবে (৫) সংশ্লিষ্ট গৃহ সম্পত্তি নির্মাণ বা পুনঃনির্মাণের জন্য গৃহিত ঋণের সুদ যদি ব্যাংক অথবা আর্থিক প্রতিষ্ঠান হতে ঋণ গৃহীত হতে হবে”।

আইনের কথা শুনে জিতু মিয়ার কোন কিছুই মাথায় টুকল না, তবে চিন্তা করলেন যে বাড়ীটা যখন খালি থাকবে তখনই ট্যাক্স অফিসকে জানাতে হবে তা আবার লিখিত কপি সংরক্ষন করতে হবে। এটা আসলে তার মত সাধারণ লোকের পক্ষে করা খুবই কঠিন কাজ। উনার বাড়ীর প্রায়ই একটা দুইটা খালি থাকে। বাড়ী ভাড়া দিতে হবে লিখিত চুক্তিপত্রের মাধ্যমে আর জিুত মিয়া তো মুখে মুখেই বাড়ী ভাড়া দিয়ে থাকেন। আর জিতু মিয়া তো পাশের মার্কেটের সমবায় সমিতি থেকে কিছু টাকা লোন নিয়ে সুদ তো ভালই দিচ্ছেন, ব্যাংক অথবা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নেন নাই।

এতকিছু চিন্তা করতে করতেই রফিস স্যার বললেন আরও একটা আইনের ধারার কথা বলি, সেটা হলো “আয়কর আইন ১৯৮৪, ধারা-৩৫, বিধি ৮এ অনুসারে বাড়ী ভাড়া বাবদ মাসিক সর্বমোট ২৫ হাজার টাকার বেশি প্রাপ্ত হলেই, বাড়ী ভাড়ার টাকা ব্যাংক হিসাবে জমা করার বিধান করা হয়েছে, তা সঠিকভাবে পালন করা ও আলাদা হিসাব রাখা। ব্যাংকের মাধ্যমে সম্পূর্ণ বা আংশিক জমা না দেওয়ার কারণে ১২৩(২) ধারার বিধান অনুযায়ী বাড়ী ভাড়ার উপর প্রদেয় করের ৫০% অথবা ৫,০০০ টাকা জরিমানা হিসাবে আরোপ হবে”।

কথায় আছে না এটা যেন ফোড়ার উপর বিশ ফোড়া্ জিতু মিয়ার হলো তাই, জিতু মিয়ার ভাড়াটিয়ারা তো ভাড়া দেন মাসের ১০ তারিখে, কেউ ২০-২৫ তারিখেও দেন আবার একজন আছে তিনি এক মাসের ভাড়া ২ মাস পরেও দেন আর যখনই ভাড়া পান তখনই খরচ করে ফেলেন, কিভাবে বাংকে জমা করবেন। তারপর তো আছে পানির বিল, বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, এলাকার মালিক সমিতির চাঁদা, পাশের ক্লাবের চাঁদা, হোল্ডিং ট্যাক্স, দুইদিন পর পরই বাসার এটা ওটা পরিবর্তন করতে হয় সব মিলে জিতু মিয়ার মাথায় বাজ পরলো।

অনেক চিন্তার পর পাশের দোকান থেকে এক লিটারের একটা কোক, বিস্কুট ও কিছু চানাচুর কিনে আনলেন আর রফিক স্যারকে নিয়ে বসার রুমে বসলেন। নাস্তা করার পর রফিক স্যার জিতু মিয়ার অবস্থা বুঝে একটা প্রস্তাব দিলেন। আচ্ছা, জিতু মিয়া আমি আপনার অবস্থা বুঝতে পারছি আসলে এটা একটা কঠিন কাজ আপনার পক্ষে করা সম্ভব না, আপনার উপকারের জন্য বলছি যে, আপনি আমাকে কিছু টাকা দিবেন, আমি সব কাজ করে দেব, আর আপনার কোন ঝামেলা করতে হবে না। এই কথা শুনে জিতু মিয়া মনে করলো যে, সে একটা আলাউদ্দীনের চেরাক পেয়েছেন। জিতু মিয়া রফিক স্যারকে কাগজ পত্র আর কিছু টাকা দিয়ে বিদায় দিল। প্রিয় পাঠক ভাবুনত; জিতু মিয়ার এই প্রস্তাবটা গ্রহন করা ছাড়া আর  কি বা করার ছিল? (চলবে)

লেখকঃ-  আইটিপি কন্সালটেন্ট, শফিক কন্সালটেনসী ফার্মস, এবিসি বাংলাদেশ লিমিটেড