ভ্যাট আইন-২০১২ ভাষার বিন্যাসেও বিনাশ বাস্তবায়ন

Posted on May 13, 2020

মোঃ আলীমুজ্জামান; সে অনেক যুগ আগের কথা যখন দশ গ্রাম খুজলে একজন পড়ালেখা জানা লোক পাওয়া যেত। সে সময়ে এক কৃষক তার ছেলেকে একটা চিঠি লেখার জন্য এক পড়ালেখা জানা লোককে অনুরোধ করলেন। তিনি বললেন ভাই আমি এখন লিখতে পারব না কারণ আমার পায়ে ব্যাথা। কৃষক খুব অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, আপনি লিখবেন হাত দিয়ে এটার সাথে পায়ে ব্যাথার কি সম্পর্ক? উত্তরে শিক্ষিত লোকটা বললেন, আমার লেখা পত্র তো নিজে গিয়ে পড়ে দিয়ে আসতে হবে কারণ অন্য কেউ সে লেখা পড়তে পারে না। আজ আমার লেখার শিরোনাম এ কঠিন ভাষার ব্যবহার করলাম, যাতে করে সেটার ব্যাখ্যার দরকারে আমার কাছে আসতে হবে। বিষয়টা অনেকটা আমাদের দেশে বর্তমানে প্রচলিত ভ্যাট আইনে ব্যবহৃত ভাষার মত। আইন লেখার সময় বাংলা ভাষা এত সুন্দর ভাবে সাজানো বা বিন্যাস করা হয়েছে সেটা তুলনাহীন আর যখন সেটা ব্যবহার বা বাস্তবায়নে এল তখন প্রতিটা শব্দের অর্থ বোঝার জন্য যেতে হয় এনবিআর এ। সেখান থেকে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয় সেটা আগের লেখার অর্থ বা ফিল্ড থেকে যা বোঝার জন্য চাওয়া হয়েছে এই দুইটার কোন টা না বোঝায়ে হয়ে যায় তৃতীয় কোন অর্থ, কারণ যিনি প্রথমে লিখেছিলেন তিনি তো বদলি হয়ে গেছেন। তাই ভ্যাট আইনে ভাষার এই বিন্যাসে এখন সেটা বিনাশ বাস্তবায়ন।

একবার এক ছেলে দোড়ে বাজার থেকে বাড়ীতে এসে হাফাতে হাফাতে মা কে বলল, সম্মানী লোকের সম্মান আল্লাহ রাখেন। বাজারে বাবাকে ধরে কিছু লোক মারছে আর আমি কোন মত মান সম্মান রক্ষা করে পালিয়ে এসেছি। ভাগ্য ভাল আল্লাহ করোনা ভাইরাস দিয়ে নতুন ভ্যাট আইন প্রনেতাদের সম্মান রক্ষা করেছেন না হলে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতির কারনে সরকারের মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের দায় তো সরকার প্রধানের উপর যেত। যেখানে পুরাতন ভ্যাট আইনে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ভ্যাট আদায়ের টার্গেট ছিল ১.০৪ লক্ষ কোটি টাকা বিপরীতে আদায় হয়ে ছিল ৮৭.৬১ হাজার কোটি টাকা। আর নতুন ভ্যাট আইনে চলতি অর্থ বছরে ভ্যাট আদায়ের টার্গেট ছিল ১.২৮ লক্ষ কোািট টাকা তার বিপরীতে ডিসেম্বর-২০১৯ পর্যন্ত আদায় হয়েছিল ৪১ হাজার কোটি টাকা যা বিগত বছরের ডিসেম্বর-২০১৮ সময়ের চেয়ে ভ্যাট আদায় শতকরা সাত ভাগ বেশী হলে ও এটি (এ্যাডভান্স ট্যাক্স) বাবদ যা ফেরতযোগ্য শতকরা পাচ ভাগ অর্থাৎ প্রকৃত ভ্যাট আদায়ের গ্রোথ ছিল শতকরা দুই ভাগ। যেখানে বলা হয়েছিল নতুন ভ্যাট আইন রাতারাতি ভ্যাট আদায় দ্বিগুন করে দিবে। নতুন ভ্যাট আইন এত চমকের চমকানিতে শেষ দৃশ্যে করোনা ভাইরাসের আর্বিভাবে করিতকর্মাদের মান রক্ষা হল কারণ মানুষের ডান হাত ও বাম হাত আল্লাহ প্রদত্ত হলেও অন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ ও কারিষমাটিক হাত এই ধরনের মানুষেরা তৈরী করতে পারেন। সেটার নাম অজুহাত, সেটার ব্যবহার করে খুব সহজে এবারের মত পার পেয়ে যাবেন। একটা ভাল ভ্যাট আইন তৈরীর উদ্দেশ্য নিয়ে নতুন ভ্যাট আইন -২০১২ তৈরী করার কাজ শুরু হয় যেটার মূল উদ্দেশ্য ছিল এক হারে সকল স্তরের ভ্যাট ব্যবস্থাপনা। এই আইন বাস্তবায়নের জন্য আট বছর ধরে এক হার,এক ব্যবস্থা প্রচার ও ট্রেনিং প্রদান করা সহ ব্যবসায়ীদের সাথে সভা সেমিনার করা হয়। সকল পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়ে দেবশক্তি শক্তি প্রাপ্ত এক দেবদূত এর আর্শিবাদে ২০১৯-২০ অর্থ বছরের বাজেট ঘোষণার সময় পূর্বের ন্যায় বহু হার সহ আইনের একটা ধারার সাথে অন্য ধারার কোন সমন্বয় না করে জগাখিচুরী মার্কা একটা ভ্যাট আইন ঘোষণা করা হল আর সাথে বোনাস হিসাবে যোগ করা হল এটি (এ্যাডভান্স ট্যাক্স) নামের এক চমক।

আপনারা ভাবছেন, সাত খন্ড রামায়ন পড়ে এখন বলছি সীতা রামের মাষি, না হলে কেন ভ্যাট এর মধ্যে এ্যাডভান্স ট্যাক্স নিয়ে আসলাম। মূসক = মূল্য সংযোজন কর অর্থাৎ যে কোন মূল্যের উপর নতুন করে মূল্য সংযোজন হলে তার উপর ১৫% হারে যা আদায় করা হবে সেটার নাম হবে ভ্যাট আর যদি মূল্য সংযোজন ছাড়া সেই একই মূল্যের উপর আবার ৫% হারে আদায় করা হয় সেটার নাম তো সংগা অনুসারে ভ্যাট বলা যায় না। সহজে দুই টা মিলে একবারে ২০% হারে ভ্যাট নামে আদায় করলে তো এটির জন্ম দেওয়ার দরকার ছিল না। নতুন ভ্যাট আইনের শুরুতে বলা আছে ভ্যাটের সর্বোচ্চ হার হবে ১৫% এবং এর বিচরণ ভ্যাটের আওতায় সীমাবদ্ধ থাকবে। তাই দরকার হল সকল জায়গায় বিচরণের ক্ষমতা প্রাপ্ত বিষয় তাই সেটার নতুন নামকরন করা হল এটি বা এ্যাডভান্স ট্যাক্স। এমন কারিশমায় ভাষার বিন্যাস করা হল যে ভ্যাট আইন পাস করে, প্রয়োগের আগে কেউ বুঝতে পারছিলেন না এটা ভ্যাট আইন না ট্যাক্স আইন এর সাথে যাবে। এটা তো গেল কেন ভ্যাট আইনে বোনাস এর নামকরণ। আর আইনে বোনাস এর ক্ষমতা বলতে গেলে সহজে বলা যায়, এত সুবিন্যাস্থভাবে ভ্যাট আইনকে সিজার করে যে টার জন্ম দেওয়া হল, সেটা তো অবশ্যই পৃথিবীর ভ্যাট আইনের ইতিহাসে প্রথম সিজারিয়ান বেবী যা জুলিয়াস সিজারের (পৃথিবীর প্রথম সিজারিয়ান বেবী) মত প্রতাবশালী হবে এটাতে কারো সন্দেহ থাকলে পাপ হবে। উপরের বিষযে একটা কথা মনে পরল, একবার আমার এক বস আমকে বললেন আমরা যারা উপরে অবস্থান করি তারা নিচের সবাইকে পোকা মাকর মনে করি। আমরা যা বোঝাবো ওরা সেটাই বুঝবে। আমি উনাকে বললাম স্যার ভূলে যাবেন না, এই সমস্ত পোকা মাকরের মধ্যে ঘুনপোকা নামে একটা পোকা আছে। সেটা যদি কোন মত চেয়ারে লাগতে পারে তবে চেয়ারের পা ভেংগে পরে যাবেন টের ও পাবেন না। গল্পের ব্যাখ্যা দেওয়ার দরকার নাই তাহলে চাকরী থাকবে না।

আমাদের নতুন ভ্যাট আইনের বোনাস জুলিয়াস সিজার (এটি) ব্যবসায়ীর জন্য সুখকর না হলেও ক্যারিসম্যাটিক ভ্যাট আইন প্রনেতাগণ বিনাসুদে সরকারী কোষাগারে হাজার হাজার কোটি টাকা জমা করার এক মহা পরিকল্পনা নিয়ে ভ্যাট আইনে প্রথম সিজারিয়ান বেবীর জন্ম দেন। বসুন্ধরা গ্রুপে চাকরী করার সময় এক স্যার আমাকে বলেছিলেন খেলা শেষ হওয়ার দশ মিনিট আগে যে অতিরিক্ত খেলোয়ার হিসাবে মাঠে আসে তাকে সারা মাঠেই দেখা যায়। আগের আশি মিনিট খেললে দম বোঝা যেত। নতুন কেউ কোন কোম্পানীতে আসলে এমন আচরন করে যে একদিনে সব লাভ করে দিবে। বিষয়টা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। সেরকম একজনের আর্শিবাদে যার জন্ম সেটার বিচরণও যে অবাধ হবে সেটা ধরে নিতে কারো কষ্ট হওয়ার কথা না। তাই যে কোন ধরণের আমদানীর জন্য জুলিয়াস সিজারকে নজরণার ব্যবস্থা করে দেওয়া হল অর্থাৎ সকল আমদনীর উপর ৫% হারে এ টি প্রদান করতে হবে। যদি সেটা আমদানীকারকের উৎপাদন ও ব্যবসায় পর্যায়ে বিক্রয় ভ্যাট এর সাথে সমন্বয় করা না যায় বা ভ্যাটে অব্যহতি থাকে তাহলে আমদানীকারক স্ব স্ব কমিশনারের নিকট আবেদন করলে মাননীয় কমিশনার মহোদয় আবেদন প্রাপ্তির পনের দিনের মধ্যে সেটা ফেরত প্রদান করবেন। মনে করছেন খুব ভাল, ফেরত দেওয়ার কথা সুন্দর করে আইনে বলা আছে। শুধু বলা থাকলে তো আর হল না, সিজারের বেবী বলে কথা তাকে কি এত সহজে যার তার হাতে তুলে দেওয়া যায়? সেটার জন্য একটা নীতিমালা থাকতে হবে। সে কি ভাবে স্ব স্ব কমিশনারে কাছে আসবে কারণ তাকে তো কাষ্টমস হাউজ গুলিতে ইনকিবিউটরে রাখা হয়েছে।

নতুন ভ্যাট আইন প্রনেতাগণ জুলিয়াস সিজারকে (এটি) তুরুপের তাস ধরে, পূর্বের ন্যায় সকল কমিশনারেট গুলিতে ভ্যাট আদায়ের বৃদ্ধির হার ঠিক রেখে লক্ষমাত্রা নির্ধারন করা হয়। অন্যদিকে এই মহান জুলিয়াস সিজারের (এটি) জন্মের সাথে সাথে পরিবর্তন আনা হল বিভিন্ন সরকারি সার্টিফিকেট/বন্ড বিক্রির নীতিমালায়, যা আগের বাজেটগুলিতে সরকারের লোনের মূল উৎস ছিল। শেয়ার মার্কেটের মহামারী এবং ব্যাংক ডিপোজিটের সুদের হার কম হওয়ায় এগুলো ছিল পেনসন ভোগী ও সাধারন মানুষের জমানো টাকার নিরাপদ বিনিয়োগ। আমদানীকারকগণ জুলিয়াস সিজার (এটি) হিসাবে যে টাকা সরকারী কোষাগারে জমা প্রদান করবেন সে টাকা সরকার খরচ করার জায়গা পাবেন না তাহলে কেন সরকার অধিক হারে সুদ প্রদান করে রাষ্ট্রীয় খরচ বৃদ্ধি করবেন। সরকারের খরচ কমাতে না পারলে পেশার মূল্য কোথায় থাকল। আবার অনেক ব্যবসায়ীরা ফেরতের আবেদন করে আইনের কোন মারপ্যাচে পরে আরো ভ্যাট প্রদান করতে হতে পারে সে ভয়ে কমিশনারের নিকট ফেরত চাওয়ার আবেদন করবেন না এভাবে শত শত কোটি টাকা সরকারী কোষাগারে জমা থেকে যাবে। আমরা এতদিন এক ঢিলে দুই পাখি মারার প্রবাদ শুনেছি আর জুলিয়াস সিজার যদি এক ঢিলে চার পাখি মারতে না পারলো তাহলে নামকরনের সার্থকতা কি রইল।

আজ নতুন ভ্যাট আইনের বোনাস জুলিয়াস সিজার (এটি) জন্ম দেওয়ার ভাষার বিন্যাস লেখে শেষ করতে চাই কারণ এর বিনাশ বাস্তবায়নে লিখলে অনেক বড় হয়ে যাবে। বিষয়টা ছোট আকারে লিখলে জুলিয়াস সিজারের অবমাননা হলে আমার মাথা কাটা যেতে পারে। সেটা নিশ্চয়ই আপনারা চাইবেন না আর লেখার সময় যা জানি সেটা সবার সাথে শেয়ার করতে না পারলে ভাল লাগে না। কিছু তো পরিবর্তন করতে পারছি না, শুধু লিখব, সেটাও আবার কম করে। এটা অনেকটা গরীবের ঘোড়া রোগের মত আর কি। ঘোড়া রোগ বলতে ঘোড়ার যে রোগ হয় সেটা কিন্ত না, গরীব মানুষ ঘোড়ায় চড়ে বাতাস খাওয়ার মত শখ আর কি। বিষয়টা আরো পরিস্কার করে বলি, সৈয়দ মুজতবা আলীর গল্পের সেই বিখ্যাত ঝান্ডুদা চরিত্রের কথা সবার মনে আছে? যিনার একবার বিদেশের বিমান বন্দরে মিষ্টি ভর্তি টিন চেক করার নামে উনার টিন খুলে সকল মিষ্টি বিমান বন্দরের কর্মকর্তারা খেয়ে ফেলছিলেন। তখন উনার মনে হল, অফিসারগণ যদি বাংলা ভাষা বুঝতেন তবে ”সালা” বলে একটা গালি দিয়ে মনের ক্ষোভ মিটাতে পারতেন। আমার বিষয়টাও সে রকম ধরে নিয়ে আগামী পর্বে শেষ করার বিষয়টা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল।

লেখকঃ- 
লিড কন্সালটেন্ট (ভ্যাট, ট্যাক্স ও কাষ্টমস), দ্যা রিয়েল কন্সাল্টেশন, বনানী, ঢাকা
সাবেক জেনারেল ম্যানেজার (ভ্যাট, ট্যাক্স ও কাষ্টমস), ক্রাউন সিমেন্ট গ্রুপ।