কর্পোরেট সংবাদ: রাজধানীর ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে নির্বাচনী মাঠ এখন সরগরম। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থীরা এখন ব্যস্ত প্রচার-প্রচারণায়। তারা এখন ঢাকার সমস্যাগুলোর সমাধানের কৌশল নিয়ে ভোটারদের সামনে হাজির হচ্ছেন। এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, ভোটাররা তাকেই নির্বাচিত করবেন, যারা ঢাকার সমস্যাগুলোর আশু সমাধান করতে পারবেন।
কারণ রাজধানী ঢাকা এখন বহুমুখী সমস্যায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানে বারবার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও কোনোটারই সুষ্ঠু বাস্তবায়ন না হওয়ায় সমস্যাগুলো এখন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এগুলোর তালিকা তৈরি করলে অনেক লম্বা হবে। যে প্রার্থী নির্বাচিত হবেন, তারা নিশ্চিত করবেন কোনো সমস্যাটির সমাধান আগে করা প্রয়োজন। এসব সমস্যা কার্যত এই শহরটাকে অকার্যকর করে ফেলছে। এই যান্ত্রিক শহরে প্রাণ ফেরানোটাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই শহরে থাকা মানুষগুলো প্রতিদিন সমস্যা নিয়েই বাসা থেকে বের হচ্ছে আবার সমস্যার মাঝেই বাড়ি ফিরছেন। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ জীবিকার সন্ধানে ঢাকামুখী হচ্ছেন। এদের অনেকেই আবার সেখানে স্থায়ী বসবাস করার জন্য চেষ্টা করছেন। অনেক আগেই ঢাকার জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে মেগাসিটি হয়েছে। সেই জনসংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বাইরে বের হয়েই প্রথম যে সমস্যায় পড়তে হয়, তা হলো যানজট। ঢাকার মানুষ দৈনিক রাস্তায় চলতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করছেন রাস্তায় গাড়িতে। প্রতিদিন যানজটে পড়ে ঢাকার মানুষের লাখ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এত কর্মঘণ্টা নষ্ট হওয়ায় বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
গত বছরের এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকায় বর্তমানে ঘণ্টায় গড় গতি ছয় কিলোমিটার। আর কিছুদিন পর এই গতি চার কিলোমিটারে নেমে আসবে। যানজট কেবল ঢাকার সমস্যা নয়, বরং এশিয়ার কয়েকটি দেশসহ অনেক বিশ্বেই যানজট মারাত্মক সমস্যা হয়ে বসে আছে। বিশেষ করে যেসব শহরের জনসংখ্যা ধারণক্ষমতা অতিক্রম করেছে এবং শহরটি ঢাকার মতো অপরিকল্পিত। যার যেভাবে খুশি বড় বড় বিল্ডিং তৈরি করে রেখেছে। রাস্তার ভেতর গাড়ি পার্ক করে রাখা হয়। তবে ঢাকার মতো এত প্রকট আকার ধারণ করা শহরের সংখ্যা এত নেই। কিছু কিছু এলাকায় তো গাড়ির গতির চেয়ে মানুষের হাঁটার গতিই বেশি! তাহলে একসময় কি ঢাকা স্থবির হয়ে যাবে? যানজট নিরসনে বহুবার বহু উদ্যোগ নেওয়া হলেও কার্যত তা ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিদিন ঢাকায় গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। ব্যক্তিগত গাড়ির চাপে ঢাকার ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা।
দেখা যায় এক পরিবারে একটি গাড়ি হলেই চলছে, সেখানে একাধিক গাড়ি কিনে রাস্তায় নামাচ্ছে। এসব টাকার কুমির নিজেদের আরাম-আয়েশের জন্য জনগণের ভোগান্তি বাড়াচ্ছে। যানজটের এ অবস্থার জন্য ওয়ার্ল্ড ট্রাফিক, ট্রাফিক ইনডেক্স-২০১৯-এ প্রকাশিত তথ্যে আমরা আছি প্রথম অবস্থানে। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে কলকাতা। গত বছর ও তার আগের বছর এই অবস্থান ছিল যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয়। ২০১৫ সালে এই অবস্থান ছিল অষ্টম। আমরা দ্রুতই নিজেদের জায়গা পরিবর্তন করেছি।
ঢাকার রাস্তায় ব্যক্তি মালিকানাধীন গণপরিবহন, প্রাইভেট কার, মাইক্রো বাস, মোটরসাইকেল এসব যানবাহন প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকা যেন থমকে আছে। এই অবস্থার উন্নতি না হলে কী হবে, তা সময়ই বলে দেবে। ঢাকার যানজট বৃদ্ধির জন্য বাস্তবিকপক্ষে পারস্পরিক কয়েকটি বিষয় দায়ী। যানবাহনের সংখ্যা যেমন লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে ঢাকার রাস্তার অবস্থা সেই আগের মতোই রয়ে গেছে। ট্রাফিক সিগন্যাল আর ১০টা সাধারণ আইনের মতোই মেনে চলার তেমন কোনো আগ্রহ নেই। তাই কয়েকবার ডিজিটাল ট্রাফিক সিগন্যাল চালু করেও সাফল্য পাওয় যায়নি। বাধ্য হয়েই ট্রাফিক পুলিশকে রাস্তায় কঠোর হতে হয়। লোকাল বাসগুলো সব সময় একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে চলেছে। উল্টোপথেও চলছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের গাড়ি। একবার জ্যাম তৈরি হলে তা আর যেন ছাড়ার নাম থাকে না। কারণ ততক্ষণে পেছনে শত শত গাড়ির বহর। ফলে অল্প ভুলে এভাবে যানজট ভোগান্তি সৃষ্টি করছে।
যানজট নিরসনের জন্য ঢাকায় নির্মাণ করা হয়েছে কয়েকটি ফ্লাইওভার। কিন্তু এসব ফ্লাইওভার তৈরি করেও সমস্যা সেই গোড়াতেই থেকে গেছে। শহরের ভেতরে গাড়ি চালানোর নিয়মকানুনের কোনো তোয়াক্কা করছেন না চালকরা। ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ভেতর আনতে হবে। একটি ছোট পরিবারের জন্য একটি গাড়ি থাকতে হবে। সড়ক পরিবহন খাতের বিশৃঙ্খলা ফেরাতে হবে। স্বল্প দূরত্বে সাইকেলের মতো যানবাহন জনপ্রিয় করে তুলতে হবে। এতে একদিকে যেমন যানজটের মাত্রা কমানো যাবে; অন্যদিকে দূষণের মতো বিষয় থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। প্রতি মাসে যে যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে; সেসব গাড়ি রাখার মতো জায়গা ঢাকায় নেই। এরই মধ্যে এ শহরের ধারণক্ষমতার চেয়েও বেশি পরিমাণ যানবাহন চলাচল করে। বলাই বাহুল্য এর বেশির ভাগই ব্যক্তিগত। কারো আরাম-আয়েশের জন্য প্রতিনিয়ত কষ্ট পেতে হয় পাবলিক বাসে যাতায়াত করা মানুষকে। প্রার্থীদের অবশ্যই প্রথমে ঢাকাকে সচল রাজধানী করার উদ্যোগ নিতে হবে।
ঢাকার মানুষের জন্য আরেকটি বড় ঝুঁকি হলো দূষিত বায়ু। বায়ুদূষণে ঢাকার অবস্থা সংকটজনক। ঢাকাকে সবুজ করতে হবে। সেই সবুজায়ন কীভাবে করা সম্ভব তার পরিকল্পনা করতে হবে। আমাদের দেশের অন্য শহরের তুলনায় রাজধানীর বায়ুদূষণের মাত্রা বেশি। ঢাকার বাতাসে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকর পদার্থ রয়েছে; যা নিঃশ্বাসের সঙ্গে দেহের অভ্যন্তরে পৌঁছে নানা রোগের জন্ম দিচ্ছে। অথচ প্রতিদিন ঘর থেকে বের হয়েই বিষাক্ত বাতাস টানতে হচ্ছে এ শহরের মানুষকে। একদিকে ইট-কাঠের শহর থেকে গাছের সংখ্যা একেবারে কমে যাওয়া; অন্যদিকে ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়া যানবাহনের ধোঁয়া, আশপাশের ইটভাটার ধোঁয়া এসব মারাত্মকভাবে বাতাসে ক্ষতিকর পদার্থের জন্ম দিচ্ছে।
পানি মানুষের নিত্যদিনকার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপাদান। অথচ সেই পানির অবস্থাও সুবিধার নয়। ঢাকাবাসীকে পানযোগ্য পানির নিশ্চয়তা দিতে হবে। ঢাকার আশপাশের নদীগুলোকে আমরা প্রায় মেরে ফেলেছি। খাল ধ্বংস করেছি। সেগুলো রোধ করতে হবে এবং উদ্ধার করতে হবে। অনেক কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। সেসব উন্নয়নমূলক কাজে যেন গতি আসে; সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। যারা নির্বাচিত হবেন, তাদের কঠোর হাতে দখলকারীদের মোকাবিলা করতে হবে। জনগণের কাছে যে প্রতিশ্রুতি তারা এখন দিচ্ছেন; সেগুলো যেন নেহায়েত মুখের কথা না হয়, তা প্রমাণ করতে হবে। এত সব সমস্যা নিয়ে রাজধানীকে তিলোত্তমা নগরী রূপে ফিরিয়ে দিতে হবে। কাজটি কঠিন। কিন্তু সদিচ্ছা থাকলে সেই কঠিন কাজের অনেক অংশই পূরণ করা সম্ভব। আগামীর নির্বাচিত মেয়র এসব সমস্যা সমাধানে কতটুকু দক্ষ হবেন, তা সময়ই বলে দেবে।
আরো একটি চ্যালেঞ্জের কথা না বললেই নয়। তা হলো ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ। গত বছর ডেঙ্গুর যে প্রকোপ আমরা দেখেছি, যে প্রাণগুলো আমরা ঝরে যেতে দেখেছি এমন অসময়ের মৃত্যু আমরা দেখতে চাই না। মশা নিধনে সফলতা দেখাতে হবে। আগামীতে ঢাকাসহ সারা দেশবাসীই এই সফলতা দেখতে চায়। সরকারের বরাদ্দের প্রতিটি অংশ যেন জনগণের কল্যাণে ব্যয় হয়, তাই দেখতে চায়। ঢাকা যান্ত্রিক শহরের খেতাব পেয়ে গেছে। মানুষই এখানে যন্ত্র। তাই প্রাণটাই ফেরাতে হবে। শিশুদের জন্য উন্মুক্ত স্থান দিতে হবে, যাতে তারা খেলাধুলা করে বড় হতে পারে। মোটকথা রাজধানীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এবং মানুষের বসবাসের উপযুক্ত করে তোলার জন্য সঠিক পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। বহু চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করতে হবে। প্রশ্ন যখন রাজধানীর, তখন সেই চ্যালেঞ্জ হবে আরো বেশি।
আমরা জনগণ বিশ্বাস করি, যারা মেয়র পদে প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, তারা এসব বিষয় মাথায় রেখেই কাজ করতে চান। তারা জনগণের সমস্যার সমাধান করতে চান। তাই ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে তাদের দক্ষতার সবটুকু উজাড় করে দিতে হবে।
© ২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | কর্পোরেট সংবাদ সম্পাদক - মোঃ মিজানুর রহমান । উপদেষ্টা সম্পাদক- জেসমিন আক্তার, এফসিএস ই-মেইলঃ corporatesangbad@gmail.com । ফোনঃ ০২২২-৩৩৫৪১২৫ । মোবাইলঃ ০১৭১১০৭৬৮১৫ অফিসঃ ৫৫/বি, নোয়াখালী টাওয়ার, ১১ তলা, সুইট ১১-এফ, পুরানা পল্টন, ঢাকা ১০০০ |
ঢাকাকে বাসযোগ্য করাই নির্বাচিত প্রার্থীর বড় চ্যালেঞ্জ https://corporatesangbad.com/270051/ |