রাতে বাসায় ফিরে টিভি দেখছিলাম। আমার মিসেস আমার পাশে বসে বাচ্চাদের পরীক্ষার খাতা দেখছিল। বাচ্চারা স্কুলে কেমন লেখাপড়া করে, পরীক্ষায় কতটা উন্নতি-অবনতি হলো তা অভিভাবকদের জানার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ পরীক্ষার খাতা বাসায় পাঠিয়ে দেন। বাচ্চার মা গভীর মনোযোগ দিয়ে সেই পরীক্ষার খাতা দেখছে। কিছুক্ষণ পর বিস্ময়দৃষ্টিতে দেখি তার দু-চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কি হল, এমন করে কাঁদছো কেন? সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, মেয়ের ক্লাস ওয়ানের পরীক্ষায় রচনা লিখতে দিয়েছে ‘আমার ইচ্ছা এমন যদি হতো”। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তাতে কাঁদার কি হলো? সে উত্তর দিল, খাতা দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না তাই চোখ দু’টো জলে ভরে উঠল-বলেই সে খাতাটি আমার দিকে এগিয়ে দিল।
আমার খুব ইচ্ছা আমি স্মার্ট ফোন হবো। কারণ, আমার বাবা-মা স্মার্ট ফোনকে খুব ভালবাসে। কিন্তু আমায় ভালবাসে না। বাবা যেখানেই যায় স্মার্ট ফোনটি সঙ্গে নিয়ে যায়। কিন্তু আমাকে নিয়ে যায় না। রিং এলেই মা দৌঁড়ে গিয়ে স্মার্ট ফোনটি ধরে। আমি কান্না করলেও আমার কাছে আসে না।
বাবা অফিস থেকে বাসায় এসে সারাক্ষণ স্মার্ট ফোনে ফেসবুক দেখে। বন্ধুদের সাথে চ্যাট করে, কথা বলে, গল্প করে-কিন্তুু আমাকে কোনো গল্প শোনায় না। আমি বাবার ছোটবেলার গল্প শুনতে চাই, বাবার স্কুল জীবনের গল্প শুনতে চাই। কিন্তুু বাবা আমাকে কিছুই বলে না। আমার কথা শুনতেই চায় না। কত বলি বাবা আমাকে একটু কোলে নাও না। তুমি সারাদিন অফিসে থাক, আমি তোমার কোলে চড়তে পারি না। কিন্তু বাবা আমাকে কোলে নেয় না। স্মার্ট ফোন কোলে নিয়ে বাবা বসে থাকে।
আমি বাবার সাথে পুতুল খেলতে চাই, ঘোড়ায় চড়া খেলতে চাই, বাবার ঘাড়ে উঠতে চাই। বাবা আমার কথা শোনে না। সারাক্ষণ স্মার্ট ফোন নিয়ে খেলে। আমার সাথে খেলার সময়ই হয় না বাবার।
মাকে যখন বলি মা চলনা একটু চড়ুইভাতি খেলি, আমি তোমার কাছে রান্না শিখব। আমি নিজে রান্না করে তোমাকে আর বাবাকে খাওয়াব। মা আমার কথা শোনে না। রেগে গিয়ে বলে, দেখতে পারছ না, আমি স্মার্ট ফোনে তোর মামার সাথে চ্যাট করছি। তারপর এক সময় ঘুমিয়ে যাই। সকালে উঠে আবার বুয়ার সাথে স্কুলে যাই। মায়ের সাথে আর চড়ুইভাতি খেলা হয়না।
সন্ধ্যা বেলায় বাবা আসতে দেরি করলে মা স্মার্ট ফোনে বাবার সাথে কথা বলে, পাপ্পি দেয়, কিন্তু আমি কাছে গেলেই আমাকে ধমক দেয়, বলে যাও, গিয়ে পড়তে বসো, বড়দের কথা শুনতে হয় না।
বাবা প্রতিরাতে মাথার পাশে স্মার্ট ফোন নিয়ে ঘুমায় কিন্তু আমাকে কখনো জড়িয়ে ধরে ঘুমায় না। কত বলি বাবা আমাকে একটু ঘুম পাড়িয়ে দাও না। আমাকে একটু ঘুম পাড়ানি গল্প শোনাও না। কিন্তু বাবা আমার কথা শোনে না। বলে চোখ বুজে থাক ঘুম এসে যাবে। মাকে গিয়ে বলি, বাবা আমার কথা শোনে না তুমি আমাকে একটু ঘুম পাড়ানি মাসিপিসির গল্প বলে ঘুম পাড়িয়ে দাও না। কিন্তু মা-ও আমার কথা শোনে না। চেঁঁচিয়ে বলে, তোমার বাবা কি বলে তুমি শুনতে পাওনা। যাও গিয়ে শুয়ে পড়। তারপর আমি কাঁদতে কাঁদতে একাই ঘুমিয়ে পড়ি।
মা-বাবা কেউ রাতে তাদের স্মার্ট ফোনে চার্জ না দিয়ে ঘুমায় না,কিন্তু মাঝে মাঝে আমাকে খাবার দিতে ভুলে যায়। আমি কান্না করলে বলে, বুয়ার কাছে খেয়ে নাও। দেখছ না আমি ব্যস্ত আছি।
সকালে যখন স্কুলে যাই মাকে বলি, তুমি আমার টিফিন দিয়েছতো, বুয়া টিফিন দিতে ভুলে যায়। মা বলে আমি অফিসে যাব রেডি হচ্ছি, বিরক্ত করনা দেখে নাও। বাবাকে বলি, আমাকে একটু স্কুলে দিয়ে এসো না। আমি তোমার সাথে স্কুলে যেতে চাই। রোজ রোজ বুয়ার সাথে স্কুলে যেতে ভাল লাগে না। বাবা শুধু প্রতিদিন বলে ঠিক আছে আমি কালকে তোমাকে স্কুলে নিয়ে যাব। আমি শুধু কালকের আশায় থাকি। কিন্তু বাবা আমার কথা শোনে না। স্কুলে যাওয়ার সময় বাবাকে বলি ঠিক আছে বাবা আজকে তুমি আমাকে স্কুল থেকে নিয়ে এসো। তাহলে আমাকে আর আনতে গিয়ে বুয়া বকবে না। স্কুল থেকে ফেরার সময় বুয়াকে কত বলি, আমাকে আইসক্রিম কিনে দাও, আমড়া কিনে দাও, চিপ্স কিনে দাও কিন্তু বুয়া আমাকে কিছুই কিনে দেয় না।
ছুটির দিন আমি অনেক আশায় থাকি। আমাকে হয়ত কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাবে। কিন্তু নেয় না। এখন আর বলি না। আগে অনেক দিন বলেছি, শিশু পার্ক, চিড়িয়াখানা, যাদুঘরে যাব। শুধু বলে আগামী শুক্রবার নিয়ে যাবে। কিন্তু শুক্রবার এলেই মা-বাবা সেই স্মার্ট ফোট নিয়েই পড়ে থাকে। না হয় দু’জনে মিলে বাইরে যায়। বলে অফিসের পার্টি আছে, সেখানে ছোটদের নেয়া যাবে না। আমার তখন খুব খারাপ লাগে। টিভি দেখতে ইচ্ছে করে না। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকি বাবা-মা কখন আসবে সেই অপেক্ষায়।
আমার বাবা-মা, দাদুভাই, ভাইয়া সবাই স্মার্ট ফোনকে খুব ভালবাসে। তাই আমি স্মার্ট ফোন হতে চাই। স্মার্ট ফোন হলে সবাই আমাকে ভালবাসবে, আদর করবে, কোলে নিবে, গল্প করবে, পাপ্পি দিবে, খেলবে, সব সময় আমাকে সাথে সাথে রাখবে। আমি সব সময় স্মার্ট ফোনের মত মা-বাবার সঙ্গেই থাকতে চাই।
রচনা পড়া শেষ। অনুভূতিহীন দৃষ্টিতে তাকাই স্ত্রীর দিকে। ও কাঁদছে। অশ্রুর ফোটা টপ্ টপ্ করে পড়ছে খাতার ওপর। ভিজে যাচ্ছে খাতাটি। হয়ত শিশু মনের করুণ আর্তনাদ নিষ্প্রাণ খাতাটিকেই বেদনাহত করেছে। আমি উঠে দাঁড়াতেই হাত থেকে পড়ে যায় স্মার্ট ফোনটি। পাশের রুমে মেয়েটি একা আছে। দরজা ঠেলে দেখি টেবিলের উপর দুই হাত, তার ওপর মাথা রেখে নিশ্চুপ হয়ে আছে মেয়েটি। আস্তে আস্তে ওর কাছে গিয়ে মাথায় হাত রাখতে চমকে উঠে ও। তৃষ্ণার্ত চাহনি দু’চোখ জুড়ে। আমার দুহাত ধরে চেয়ারের ওপর দাঁড়ায়। বাহু বাড়াতেই ঝাপিয়ে পড়ে কোলের ওপর। বুকে জড়িয়ে আছি কতক্ষণ খেয়াল নেই। সম্বিৎ ফিরে তখন, যখন অনুভব করি আমার ঘাড়ে হালকা গরম পানির ফোটায় পিঠটা ভিজে যাচ্ছে। কচি চোখের বেদনাশ্রুতে নিজেকে নতুন করে আবিস্কার করি। বুঝতে পারি, তথাকথিত তথ্য প্রযুক্তির মায়ায় ঔরসজাতকে তার প্রাপ্য ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। মনের অজান্তেই প্রতিজ্ঞা করি, আমার মেয়েকে আর স্মার্ট ফোন হতে দিব না, ওর মনের সকল চাহিদা আমি পূরণ করবো। মেয়েটা সত্যিকারের মানুষ হোক, আদর্শ মানুষ হয়ে আলোকিত করুক গোটা সমাজ।
লেখক: মোঃ মিজানুর রহমান এফসিএস, সম্পাদক, কর্পোরেট সংবাদ।
© ২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | কর্পোরেট সংবাদ সম্পাদক - মোঃ মিজানুর রহমান । উপদেষ্টা সম্পাদক- জেসমিন আক্তার, এফসিএস ই-মেইলঃ corporatesangbad@gmail.com । ফোনঃ ০২২২-৩৩৫৪১২৫ । মোবাইলঃ ০১৭১১০৭৬৮১৫ অফিসঃ ৫৫/বি, নোয়াখালী টাওয়ার, ১১ তলা, সুইট ১১-এফ, পুরানা পল্টন, ঢাকা ১০০০ |
অশ্রুভেজা রচনা: “আমি স্মার্ট ফোন হতে চাই” https://corporatesangbad.com/25651/ |