রোজায় মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে নিউ ইয়র্কে প্রবাসীদের মাঝে চরম উত্তেজনা

Posted on April 13, 2023

ইমা এলিস, নিউ ইয়র্ক: পবিত্র রমজান মাসে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে নিউ ইয়র্ক প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাঝে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। গত দুই সপ্তাহ ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সর্বত্রই বইছে সমালোচনার ঝড়। অধিকাংশ প্রবাসীরা চাইছে ঈদের পরে ১লা বৈশাখের আয়োজন করা হলে সর্বস্তরের মানুষ তাতে অংশ গ্রহণ করতে পারবে। এবারে প্রায় ১৫টি সামাজিক সংগঠন জাকজমকপূর্ণভাবে বাংলা নববর্ষ পালনের উদ্যোগ নিয়েছে। এরমধ্যে বেশিরভাব সংগঠনেই বাংলা নববর্ষ পালনের দিন ধার্ষ করেছে ঈদের পর। শুধুমাত্র একটি সংগঠন ১৪ ও ১৫ এপ্রিল বাংলা নববর্ষ পালনের সাথে মঙ্গল শোভাযাত্রার ঘোষনা দিলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পরে। এ ঘটনাটি এখন নিউ ইয়র্কে টক অব দ্য সিটিতে পরিণত হয়েছে। এ খবর জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম বাংলা প্রেস।

সদ্য গঠিত এনআরবি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড নামক একটি সংগঠন ১৪ এপ্রিল নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কয়ারে এবং ১৫ এপ্রিল জ্যাকসন হাইটসের ডাইভারসিটি প্লাজায় মঙ্গল শোভাযাত্রা ও বৈশাখী মেলার আয়োজনের প্রচারণা চালালে প্রবাসীদের মাঝে বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এরই মধ্যে তাদের বেশ পাঁচদফা মহড়াও অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে জানা গেছে। আয়োজকরা এটাকে বলছে শতকন্ঠে বর্ষবরণ।

পবিত্র রমজান মাসে মঙ্গল শোভাযাত্রা না করার জন্য আয়োজক সংগঠনের কর্মকর্তাদের কাছে দাবি জানিয়েছেন নিউ ইয়র্কের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা। কিন্তু তারা এসব দাবিকে কোন পাত্তাই দেয়নি। তাদের সিদ্ধান্তেই অনড় রয়েছে বলে জানা গেছে। তবে নিউ ইয়র্কের অন্যান্য সংগঠনগুলো ঈদের দিন কিংবা পরের সপ্তাহে বাংলা নববর্ষ পালনের ঘোষনা দিয়েছেন ইতোমধ্যে।

নিউ ইয়র্কের কমিউনিটির নেতৃবৃন্দরা কেউই নববর্ষ পালন কিংবা মঙ্গল শোভাযাত্রার কোনরকমের বিরোধিতা করেননি। তারা রমজানের পবিত্রতা বিনষ্টের আশঙ্কা করছেন। তারা দাবি করছেন এ আয়োজনটি এক সপ্তাহ পরে হলে প্রবাসীরা স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করতে পারতো। এর ফলে অনুষ্ঠানটি আরও সুন্দর ও সার্থক হতো। এ বিষয় নিয়ে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি কমিউনিটির নেতা আয়োজকদের সাথে যোগাযোগ করে ব্যর্থ হয়েছেন বলে জানা গেছে।

নিউ ইয়র্কসহ যুক্তরাষ্ট্রের শত শত বাংলাদেশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের নিজেরদের মন্তব্য ও যূক্তি তুলে ধরেছেন এর মধ্যে কামাল হোসেন মিঠু লিখেছেন-ক্যালেন্ডারের নিয়মতান্ত্রিক পরিবর্তনের কারনে পহেলা বৈশাখ এবং পবিত্র রমজান এবার একে অন্যের সঙ্গী হয়েছে।পহেলা বৈশাখ এই মাসে উদযাপন করা ঠিক হবে কি হবে না তা নিয়ে ঝগড়া কাইজ্জা শুরু হয়েছে। এই কাইজ্জা কিন্তু পহেলা বৈশাখের সাথে রমজান মাসের নয়। খেজুরের সাথে পান্তা ইলিশের নয়। এই কাইজ্জা মুসলমানের সাথে অন্য ধর্মানুসারীদেরও নয়। দ্বন্দ বা কাইজ্জাটা বেঁধেছে বোকার সাথে বোকার। আর এতে ব্যাপক বিনোদিত হচ্ছে হাতেগোনা কিছু রগচটা " আই ডোন্ট কেয়ার" বলে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো অতি বুদ্ধিসম্পন্ন এবং হীনমানসিকতা সম্পন্ন মানুষ। আমি যখন ইফতারের দাওয়াত দেই সেই তালিকা শুধু মুসলমানের তালিকা নয়। সেই তালিকায় মোহাম্মদ যেমন থাকেন তেমনি সাহা, বড়ুয়া যোসেফ ও থাকেন। নির্দিষ্ট সময়ে সকলে মিলে ইফতার করি। কই সেখানে তো অন্য ধর্মানুসারী বন্ধুরা প্লেট নিয়ে আগে খেতে বসে যায় না! পূজা মন্ডপে জুতোটা তো খুলেই ঢুকি। এটি একজনের প্রতি আরেকজনের সহমর্মিতা। একটি বিশ্বাসের প্রতি আরেকটি বিশ্বাসের সম্মান জানানো।

পহেলা বৈশাখ উদযাপন হবে। আমরা সবাই যাবো। কারন এই উৎসব আমাদের সকলের। ভালো হতো, যদি ইফতারের সময়টিকে একটু বিবেচনায় রাখতেন আয়োজকরা। ইফতারের সময় সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত। এর আগেই শেষ করা বা সাময়িক বিরতি দিলে কোন ক্ষতি হতো না। অনুষ্ঠানের মানও ক্ষুন্ন হতো না। বরং আমাদের মুসলমান ভাইবোনেরা আনন্দিত হতেন এই ভেবে যে আয়োজকেরা তাদের ব্যাপারটিও মাথায় রেখেছেন। তারা নিজেদের আরো সম্পৃক্ত মনে করতেন। আবার যদি সব বছরের মতো পহেলা বৈশাখ রাত অব্দি উদযাপিত হয় তাতেও ক্ষুব্ধ হয়ে হইচই বাঁধানোর কিছু নেই। রমজান মাস সংযমের মাস,উপলব্ধির মাস। রমজান মাস আত্মশুদ্ধির মাস। এই মাসে মাথা গরম করে আজেবাজে কথা প্রচার ও অনুষ্ঠান বন্ধের দুরভিসন্ধি রমজানের ফজিলতকে আহত করে। ইদানিং লক্ষ্য করছি আরেক অদ্ভুত প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। আধুনিক ও অসাম্প্রদায়িক প্রমান করার জন্য অযথা নিজ ধর্মকেই আঘাত করছি। ছোট করছি। অথচ ধর্ম পালনকারী মানেই সাম্প্রদায়িক একথা সত্য নয়!! অসাম্প্রদায়িকতা ধর্ম পালনে বা পোষাকে নয়। অসাম্প্রদায়িকতা আচরনে, সচেতনতায়। নৈতিকতা ও নিরপেক্ষতায়। অসাম্প্রদায়িকতা প্রাত্যহিক চর্চায়, পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য রক্ষায় সচেতন থাকায়। অসাম্প্রদায়িকতা অনুভবে, উদারতায়।

আমরা কেউ কারো শত্রু নই। দূর পরবাসে এই কমিউনিটির মানুষগুলোই আপনার আমার বিপদে এগিয়ে আসে। সুতরাং যেকোন উৎসবে আয়োজনে এই কমিউনিটির সকলের ভালোমন্দ, ইচ্ছা অনিচ্ছা, ভালো লাগা খারাপ লাগাকে বিবেচনায় রাখা উচিত। এতে অযথা বিভ্রান্তি, জটিলতা ও বিভাজন সৃষ্টির আশংকা হ্রাস পায়। আমরা সকলে ছোট বড় সকল আনন্দ আয়োজনে যোগ দিতে চাই৷ নিজেকে অপাংক্তেয় ভাবতে চাই না। অন্য ধর্মের প্রতি সম্মান দেখানো মানে হেরে যাওয়া নয়৷ কম বুঝলে সমস্যা ছিল না। সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে প্রয়োজনের চেয়ে অধিক বোঝায়। আমরা বুঝতে বুঝতে বৈরী হয়েছি। বুঝদার হতে পারিনি। আর এই সুযোগে কিছু হিংসুটে, ক্ষুব্ধ , কুচক্রী আপনার আমার মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির জন্যে স্ফুলিঙ্গে ফু দিচ্ছে। কেউ অভিমান করে দুটো আক্ষেপের কথা শুনিয়েছে বা কেউ যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়নি এই ভেবে আমরা যে আচরন করছি তা কি আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়া নয়!

কমিউনিটি নেতা নাসির খান পল লিখেছেন-কিছু কিছু হিন্দু, ধর্ম আর উৎসব একসাথে গুলিয়ে ফেলছেন( যেমন রীনা সাহা) পহেলা বৈশাখ একটা উৎসব, এটা আপনাদের হিন্দু ধর্মের কোন অংশ না। এটা সকল বাঙালির একটা আননদময় উৎসব। তাহলে এটা যদি ধর্ম না হয় তবে তারিখ পিছানো যাবে না কেন?

মুলত সকল বাংগালি হিন্দুরা বিশয়টা নিয়ে খুব বেশি জিদ করছেন। আমাদের মাঝে বিভাজন না এনে, আরেক ধর্মকে সন্মান দেখিয়ে আপনারা একটু sacrifice করে, এক সপ্তাহ পিছিয়ে ফেলুন।

নিউ ইয়র্ক প্রবাসী নিসার শোদ্দো লিখেছেন-বাংলা বর্ষবরণ ও মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে রয়েছে আক্ষেপ ও অভিযোগ। সংশ্লিষ্টরা আয়োজন করেছেন শতকন্ঠের বর্ষবরণ ১লা বৈশাখে। দ্বিতীয় দিন ১৫ এপ্রিল শনিবার জ্যাকসন হাইটসের ডাইভারসিটি প্লাজায় আয়োজন করেছেন মঙ্গল শোভাযাত্রা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। স্বতঃস্ফূর্ততায় সবাই সর্বদা এই পহেলা বৈশাখ উদযাপনে অংশগ্রহণ করে থাকেন কিন্তু এবারে 'রমজান' চলাকালে মুসলমানদের জন্য এই উদযাপনে অংশগ্রহণ করা আর সম্ভব হয়ে উঠবেনা। আর মাত্র সাতদিন পর অর্থাৎ ঈদের পর এই উদযাপন করা হলে তা হয়ে উঠতো সর্বজন স্বীকৃত কিংবা একে অপরের প্রতি নমনীয়তা নিয়ে আলোচনা করা যেত কিভাবে সবার গ্রহণযোগ্যতা আসবে। দু'পক্ষই যার যার জায়গা থেকে সঠিক পদক্ষেপ নিচ্ছে তবে বাইরে থেকে ব্যাপারটি কিরকম দেখাচ্ছে তা একমাত্র পর্যবেক্ষকরাই বলতে পারেন।

সংযমের এই পবিত্র রমজান মাসটিতে একে অপরের ঘনিষ্ঠ কিংবা প্রতিবেশীদের মাঝে এই আয়োজনটি ঘিরে আজ কিছুটা বিদ্বেষ বিরাজমান। 'গুটিকয়েক' মানুষের উস্কানিমূলক প্ররোচনায় ব্যাপারটি হয়ে উঠেছে জটিল থেকে জটিলতর। ছোটবেলা থেকেই সব ধর্মের অনুসারীদের শ্রদ্ধা করতে শিখেছি মা'র কাছ থেকে,আজো আমাদের সেই গতিধারা অব্যাহত আর তাইতো এই বিভাজন মেনে নেয়া দুরূহ। অনুষ্ঠানটির নেপথ্যে যারা রয়েছেন তারা নিঃসন্দেহে বিচক্ষণ, নিশ্চয়ই বুঝে শুনেই অদৃশ্য? এক কারণে এই সময়টাতেই অনুষ্ঠানটি করতে যাচ্ছেন তাই তাদের নিয়ে আমার কোন দ্বিধা সংকোচ নেই, নেই কোন আক্রোশ কিংবা অভিযোগ। উৎসব আসে আবার চলেও যাবে কিন্তু আমরা রয়ে যাব প্রতিবেশী হিসেবে তাই লজ্জায় মাথা নত হয়ে যাচ্ছে, শ্রদ্ধাবোধের জায়গাটুকু হয়তো আর থাকবেনা, চিহ্নিত হয়ে যাবে ধর্মীয় ভেদাভেদ এই বিবেকহীন কর্মকান্ডে। খুব কাছের মানুষগুলো বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে ঐশ্বরিক কোন এক অশুভ শক্তির কারণে। বিশ্বের সমস্ত বাংলা ভাষাভাষী মানুষগুলো কটাক্ষ করবে প্রকাশ্য দিবালোকে আমাদের এই হীনমন্যতায়। বসবাস করি পৃথিবীর অন্যতম উন্নত দেশ এই আমেরিকায় তাই সবার কাছে আমরা মার্জিত বলে গণ্য হয়ে থাকি। আমাদের মান-সম্মান আমরা নিজেরাই বহন করি আমাদের আচরণে, বহন করি শিক্ষাগত যোগ্যতা, বাবা মা'য়ের পরিচয় তাই আমাদের বিবেক'কে সচল রাখার দায়িত্ব আমাদের নিজেদেরই। কে কি পরামর্শ দিল তাতে কিছু যায় আসেনা কারণ বেলা শেষে আমাদের জন্যই আজকে আমাদের এই অবস্থান। সবাই ভালো থাকুন
মঙ্গল শোভাযাত্রা ও বৈশাখী মেলার আয়োজক সংগঠন এনআরবি ওয়ার্ল্ড ওয়াইডের বিশ্বজিত সাহা, তোফাজ্জল লিটন ও সঙ্গীতশিল্পী মহিতোষ তালুকদার তাপসের কাছে পৃথক পৃথকভাবে জানতে চাওয়া হয়েছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা রমজানের পবিত্রতা বিনষ্ট করবে বলেও প্রবাসীদের অনেকেই ধারণা করছেন। রোজার শেষ ১০ দিনের যে কোন বেজোড় দিনকে শবে কদরের দিন/রাত ধরা হয়ে থাকে। সেই মোতাবেক ১৪ ও ১৫ এপ্রিল ২৩ ও ২৪ রোজা। এ দু'দিনে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য কি? তারা কেউই এর সঠিক জবাব দিতে পারেননি।