চট্টগ্রাম প্রতিনিধি: চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সামনের খোলা মাঠের দু’পাশে রয়েছে এয়ারপোর্ট ‘পাবলিক টয়লেট’। এটা সুখবরই বটে। তবে বিপত্তি হচ্ছে, টয়লেট ইজারা দিয়ে বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক রাজস্ব আয় যেভাবে বাড়াচ্ছেন, ঠিক সেভাবে বাড়ছে না সেবার মান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে ক্ষমতাসীন দলের পতেঙ্গার এর ছাত্রলীগ নেতা বাপ্পী বিমান বন্দরে যাত্রীদের প্রবেশমুখের ওয়াকিংয়ের জায়গায় গড়ে তোলেছেন ‘সাজেদা এন্টারপ্রাইজ’ ফুড কর্নার! সেখানে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন খাবার ও কোমল পানীয়। অন্যদিকে, সজীব নামে স্থানীয় এক বিএনপি নেতা দুই পাবলিক টয়লেট থাবা বসিয়েছেন। সজীব আরোও একটি ভালো নাম রয়েছে।
প্রচার রয়েছে, টয়লেট ও ফুড কর্নার নামকেওয়াস্তে ইজারা দেওয়া হয়েছে। যেখানে পাবলিক টয়লেটের দেয়াল ঘেঁষেই পসরা সাজিয়েছেন ফাস্টফুড পণ্যের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ১৮ বছর ধরে বিমান বন্দরে কর্মরত এক কর্মচারী জানান, ‘যে ব্যক্তি পাবলিক টয়লেট দখল করে ব্যবসা করছেন তিনি মূলত বিমানবন্দরের অবসর প্রাপ্ত এক কর্মকর্তার ভাই। যিনি পতেঙ্গা এলাকার প্রভাবশালী বিএনপি নেতা বলে পরিচিত। বিমানবন্দর ম্যানেজারের সাথে তাঁর দহরম মহরম সম্পর্ক।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পূর্বপাশের পাবলিক টয়লেট দখল করে সাইনবোর্ড টাঙালেন ‘শাহ আমানত স্ন্যাকস কর্নার এবং ‘এম এইচ স্ন্যাকস কর্নার-০১’। মাঠের পশ্চিম পাশে পাবলিক টয়লেট দখল করে নাম দিয়েছেন ‘এম এইচ স্ন্যাকস কর্নার-০২’। একই ফুড কর্নার গুলোর অন্যপাশে চলছে প্রশ্রাব পায়খানার জমজমাট ব্যবসা। প্রবেশ করলেই ১০ টাকা।
বিমানবন্দরে আসা সরোয়ার কামাল ও আনিস নামে দু’যাত্রী বলেন, ‘ভাই পাবলিক টয়লেট থেকে শুরু করে সব জায়গায় তাঁদের থাবা। এরা এমপি মন্ত্রীর আত্মীয়। এ সুবাদে তদবির-বাণিজ্যের মাধ্যমে দোকান বরাদ্দ নিয়েছেন।’
জানা যায়, পাবলিক টয়লেট ও চত্বর ঘিরে অবৈধভাবে গড়ে উঠছে একাধিক সিন্ডিকেট। এসব সিন্ডিকেট দুই টয়লেট থেকেই হাজার হাজার গ্যালন পানি বিক্রি হয়। অসংখ্য গাড়ি ধোয়া-মোছার মাধ্যমে এরা দৈনিক হাজার হাজার টাকা তুলে নিচ্ছেন। যার একটি অংশ বিমানের অসাধু কর্মকর্তাদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা হয় বলে কানাঘুষা রয়েছে।
যদিও যাত্রীদের সুবিধার্থে বিমানবন্দর পার্কিং এ সরকারি রেইটে-বাস, মিনি বাস ও ট্রাক (৩-৫ টনের) এর প্রথম ৫ ঘন্টার অবস্থান ফি ১৫০ টাকা। অধিক হলে প্রতি ২৪ ঘন্টায় ৬০ টাকা, কার জিপ ও মাইক্রোবাস প্রথম ৫ ঘন্টা ৬০ টাকা, অধিক হলে ২৪ ঘন্টা প্রতি ২৫ টাকা এবং বাই সাইকেল প্রথম ৫ ঘন্টা ২০ টাকা, অধিক হলে ২৪ ঘন্টা প্রতি ৫ টাকা নির্ধারণ করা হলেও বাস্তবে তার দেখা নেই। দিনরাত টোকেন বাণিজ্য চলছে। বেশি টাকা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে।
মিফতাহুল হক নামে এক যাত্রী বলেন, ‘লাভের আশায় পাবলিক টয়লেট গুলো ইজারা দেওয়ায় এগুলো আর সেবা ঘর থাকে না, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। কিন্তু যাত্রী সাধারণের সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এসবের দেখাভালোর দায়িত্ব বিমানবন্দর ম্যানেজারের।’ তিনি আরও জানান, ‘পাবলিক টয়লেট এখন পাবলিকের নেই। পাবলিক টয়েলটে এক মধু যে ‘টয়লেটগুলো’ এখন ‘টাকার খনি’।
বিরক্ত ভরা কণ্ঠে যাত্রীর সাথে আসা কক্সবাজারের মোতাহের হোসেন বলেন, ‘প্রস্রাব করলেই ১০ টাকা নেওয়ার কোনো মানে হয় না। ভেতরে কোনো টিস্যু নেই, পানিতে প্যাচপ্যাচ করছে, কি যে অবস্থা! মহিলাদের জন্য আলাদা রুম থাকলেও ইজারা দেওয়া পাবলিক টয়লেট এত অপরিষ্কার বলার বাহিরে।’
পাবলিক টয়লটে টাকা আদায়কারী দুই যুবক বলেন, ‘আমাদের নাম লিখে লাভ নাই ভাই। বৈধভাবে ও নিয়ম মেনেই পাবলিক টয়লেট ইজারা নিয়েছেন আমাদের বস। একটি ১৫ লাখ করে ৩০ লাখ টাকায়।’ দৈনিক এক টয়লটে কত টাকা ওঠে জানতে চাইলে তাঁরা বলেন, ‘আগে জনপ্রতি ৫ টাকা নিতাম। তখন একটাতে ৫ হাজার করে ১০ হাজার উঠতো। এখন ১০ টাকা করে নেওয়া হয়। ফলে একটিতে দৈনিক ১০ হাজার, দুই টয়লটে মোট ২০ হাজার।’ তার মানে মাসে ৬ লাখ। বছরে ৭২ লাখ টাকা। উজারার তিন বছরে ২ কোটি ১৬ লাখ টাকা আয়!
তবে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) এর তথ্যমতে, চট্টগ্রামের হযরত শাহ আমানত বিমানবন্দরে টার্মিনাল ভবন, রানওয়ে, টাওয়ার, ফায়ার স্টেশন, রাডার স্টেশন, আবাসিক ভবন, কার্গো ভবন ও পার্কিং এলাকা আছে। সব মিলিয়ে ৬৩৬.৩৯৪ একর সম্পত্তি রয়েছে সেখানে। এর মধ্যে লিজ দেওয়া আছে ৩টি কার পার্কিং, একটি পাবলিক টয়লেট, ১৩ টি কক্ষ, একটি রেস্টুরেন্ট ও ৩টি দোকান। এ খাতে ৪.৮৭ একর জমি রয়েছে। যেখান থেকে বছরে দুই কোটি ২০ লাখ ৩৯ হাজার টাকা আসে। কিন্তু শুধুমাত্র দুই টয়লেটে ইজারার বাহিরে আয় এরচেয়ে বেশি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন তাসলিম আহমেদ (পিএসসি) বলেন, ‘পাবলিট টয়লেট দু’পাশে দুটি থাকলেও আমরা ইজারাকালে গণণা করেছি একটা। তিন বছরের জন্য এসব ইজারা দেওয়া হয়েছে ২০ লাখ টাকায়। দরপত্র ঘোষণা করে চুক্তি ভিত্তিক ইজারা দেওয়া হয়েছে। সরকারি রাজস্ব আদায় করার স্বার্থে। আর আপনি ওয়াকিংয়ের জায়গায় ‘সাজেদা এন্টারপ্রাইজ’ নামক যে দোকানের কথা বলেছেন। তা ইজারা নিয়েছেন ছাত্রলীগ নেতা বাপ্পী। সেটা সত্য। তিনি নিয়ম মেনেই তিন লাখ টাকায় ইজারা নিয়েছেন সেটি। যার মেয়াদ শেষ হবে আগামী জুনে। তখন দোকানটি তুলে দেওয়া হবে।’
বিমান বন্দরের পরিচালক আরও বলেন, ‘এয়ারপোর্ট পাবলিক টয়লেট শুধুমাত্র সাধারণ যাত্রী ও জনসাধারণের সুবিধার জন্য। টয়লেট যদি ইজারা না দিয়ে ফেলে রাখা হয়। পাবলিক নষ্ট করে ফেলবে। পরিষ্কার রাখবে না। তাই ইজারা দেওয়া হয়েছে। আবার এসব টয়লেট থেকেই পানি বিক্রি হবে। সে পানি নিয়ে মাঠের পার্কিং এ থাকা গাড়ি ধোয়া-মোছা কাজ করবে। তা পারবে না। আমরা এসব বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছি। আপনারা জাতীয় স্বার্থে সঠিক তথ্য তুলে ধরবেন। কে কি বলেছে, না বলে তা শোনবেন না। যে কোন অনিয়ম অভিযোগের সত্যতা পেলে বিমান বন্দর কতৃপক্ষ অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে।’
© ২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | কর্পোরেট সংবাদ সম্পাদক - মোঃ মিজানুর রহমান । উপদেষ্টা সম্পাদক- জেসমিন আক্তার, এফসিএস ই-মেইলঃ corporatesangbad@gmail.com । ফোনঃ ০২২২-৩৩৫৪১২৫ । মোবাইলঃ ০১৭১১০৭৬৮১৫ অফিসঃ ৫৫/বি, নোয়াখালী টাওয়ার, ১১ তলা, সুইট ১১-এফ, পুরানা পল্টন, ঢাকা ১০০০ |
সেবা নেই, আছে পাবলিক টয়লেটে মধু! https://corporatesangbad.com/23135/ |