ঋণখেলাপীদের পুরষ্কারে হুমকির মুখে ব্যাংকিং খাত

Posted on February 7, 2019

ঋণখেলাপী বন্ধে সরকারের পক্ষ থেকে যখন বার বার কঠোর অবস্থানের কথা বলা হচ্ছে, নতুন সরকারের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল যখন খেলাপী ঋণকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করছেন, ঠিক তখনই বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ঋণখেলাপীদের জন্য পুরষ্কারতুল্য সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। জানা গেছে, ঋণখেলাপীদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাতে করে খেলাপীরা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে শুরু করেছে। কারণ, দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণখেলাপীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে ঋণ অবলোপনের নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করেছে।

নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে, এখন থেকে ব্যাংকগুলো চাইলে তিন বছরের মন্দমানের খেলাপি ঋণকে আর্থিক হিসাব থেকে বাদ দিতে পারবে। আগে এই সময়সীমা ছিল পাঁচ বছর। একই সাথে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রে মামলাও করতে হবে না। আগে এই টাকার পরিমাণ ছিল পঞ্চাশ হাজার টাকা। এছাড়া এসব ঋণের পুরোটার ওপর নিরাপত্তা সঞ্চিতিও না রাখার সুযোগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নীতিমালায় যুক্তি দেখিয়ে বলা হয়েছে, দেশের ব্যাংকিং খাতের বর্তমান অবস্থা, আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চা, আইনি কাঠামো যুগোপযোগী করার লক্ষে ব্যাংকগুলোকে এই নীতিমালা অনুসরণ করতে বলা হয়েছে।

নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, যেসব ঋণ তিন বছর ধরে আদায় বন্ধ রয়েছে এবং নিকট ভবিষ্যতে আদায়ের সম্ভাবনা নেই, তা অবলোপন করা যাবে। তার আগে বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রয়ের চেষ্টা করতে হবে। গ্রাহকের ঋণের নিশ্চয়তা প্রদানকারীর কাছ থেকে অর্থ আদায়ের চেষ্টা করতে হবে। এক্ষেত্রে অবলোপনের আগে সংশ্লিষ্ট ঋণ থেকে স্থগিত সুদ বাদ দেওয়ার পর যে স্থিতি দাঁড়াবে, তার সমপরিমাণ সঞ্চিতি রাখতে হবে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন ছাড়া কোন ঋণ অবলোপন করা যাবে না। অবলোপনের পরও ব্যাংকের দাবি বহাল থাকবে। আর ঋণের দায় সম্পূর্ণ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত আগের মতোই তিনি খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবেন। অবলোপন করা ঋণ পুনঃ তফসিল বা পুনর্গঠন করা যাবে না। তবে পুরো দায় শোধ করে দেওয়ার শর্তে গ্রাহক ঋণ পরিশোধের নতুন পরিশোধ সূচি পাবেন। অবলোপন ঋণ আদায়ের জন্য প্রত্যেক ব্যাংকে বিশেষ ইউনিট গঠন করতে হবে। আর পরিচালনা পর্ষদের কারও ঋণ অবলোপন করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগবে।

নতুন এই নীতিমালার ফলে ব্যাংকগুলো খেলাপী ঋণের পরিমাণ কাগজে-কলমে কম দেখাতে পারলেও বাস্তবে হবে ঠিক তার বিপরীত। বিষয়টি নিয়ে অত্যন্ত নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন ব্যাংকিং খাতের বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এমন নীতিমালার ফলে খেলাপীঋণ আদায়ের পরিবর্তে অনাদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে হুমকির মুখে পড়বে দেশের ব্যাংকিং খাত। যদিও ব্যাংক মালিকেরা নিজেদের দুর্বলতা ঢাকার সুযোগ পেয়ে নতুন নীতিমালাকে স্বাগত জানিয়েছে।

দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ব্যাংকিং খাতের যেমন কোনো বিকল্প নেই, তেমনি যাচাই-বাছাই না করে ঋণ প্রদান এবং প্রদানকৃত ঋণ নিজেদের দুর্বলতার কারণে অবলোপন করা হলে ব্যাংকিং খাতের প্রতি বিনিয়োগকারী তথা জামানতকারীদের মাঝে বিরূপ প্রভাব দেখা দিবে। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি, বাঁধাগ্রস্ত হবে উন্নয়নের গতি।

সরকার যেখানে দুর্নীতি বিরোধী জিরো টলারেন্স নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন, সেখানে এমন ধরনের নীতিমালা দুর্নীতিবাজদের উৎসাহিত করবে বলে মনে করেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এক্ষেত্রে সরকার ঘোষিত দুর্নীতি নির্মূল কতটা ফলপ্রসু হবে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অনেকেই। বিষয়টি নিয়ে সরকারকেই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে, বন্ধ করতে হবে ঋণখেলাপি অবলোপনের সংস্কৃতি।

আরও পড়ুন: ভেজাল বন্ধে দরকার ভেজালমুক্ত মানুষ