‘করপোরেট সুশাসন প্রতিষ্ঠাই কোম্পানি সচিবের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব: মো. জাকির হোসেন

Posted on November 14, 2018

একটি প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন বিভাগ-প্রধানের সাফল্যের ওপর নির্ভর করে ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সিইও’র সাফল্য। সিইও সফল হলে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা বেশি হয়। খুশি হন শেয়ারহোল্ডাররা। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে সিইও’র সুনাম। প্রতিষ্ঠানের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও), কোম্পানি সচিব, চিফ কমপ্লায়েন্স অফিসার, চিফ মার্কেটিং অফিসারসহ এইচআর প্রধানরা থাকেন পাদপ্রদীপের আড়ালে। টপ ম্যানেজমেন্টের বড় অংশ হলেও তারা আলোচনার বাইরে থাকতে পছন্দ করেন। অন্তর্মুখী এসব কর্মকর্তা সব সময় কেবল প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য বাস্তবায়নে ব্যস্ত থাকেন। সেসব কর্মকর্তাকে নিয়ে আমাদের নিয়মিত আয়োজন ‘টপ ম্যানেজমেন্ট’। একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে এবার বায়োফার্মা লিমিটেডের গ্রুপ কোম্পানি সেক্রেটারি মো. জাকির হোসেন এফসিএস।

মো. জাকির হোসেন এফসিএস বায়োফার্মা লিমিটেডের গ্রুপ কোম্পানি সেক্রেটারি। ব্যবস্থাপনা বিষয়ের ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি রয়েছে তার। তিনি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি) থেকে সিএ (ইন্টার) ও ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশ (আইসিএসবি) থেকে চার্টার্ড সেক্রেটারি পেশাগত ডিগ্রি এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি পার্ট-১ সম্পন্ন করেন। তিনি আইসিএসবির একজন সম্মানিত ফেলো।

প্রশ্ন: ক্যারিয়ারের গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই…
মো. জাকির হোসেন এফসিএস: সিএ আর্টিকেলশিপ শেষ করার পরে ১৯৯৭ সালে বসুন্ধরা গ্রুপে অডিট অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করি। পরে হিসাব ও অর্থ বিভাগে বদলি হই। পদোন্নতি পেয়ে হিসাব ও অর্থ বিভাগের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) পদে উন্নীত হই। এরপর ২০১০ সালে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ (বিডি) লিমিটেডে প্রধান অর্থ কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিই। ওই প্রতিষ্ঠানে এক বছর দায়িত্ব পালনের পর পেশা পরিবর্তন করে ২০১১ সাল থেকে বায়োফার্মা লিমিটেডের গ্রুপ কোম্পানি সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি।

প্রশ্ন: পেশা হিসেবে কোম্পানি সচিবকে কেন বেছে নিলেন?
মো. জাকির হোসেন এফসিএস: প্রথমে হিসাব বিভাগে ক্যারিয়ার গড়ার ইচ্ছা ছিল। সেই লক্ষ্য স্থির করে সিএ ফার্মে আর্টিকেলশিপ নেই। সিএ ইন্টার শেষ করে বসুন্ধরা গ্রুপে হিসাব ও অর্থ বিভাগে কর্মজীবন শুরু করি। একপর্যায়ে বসুন্ধরা গ্রুপের উপমহাব্যবস্থাপক (হিসাব ও অর্থ) পদে উন্নীত হই। পরবর্তীকালে দেশে চার্টার্ড সেক্রেটারি পেশাগত কোর্স শুরু হলে আইসিএসবির সিলেবাস এবং কোম্পানি সেক্রেটারির ভূমিকা ও গুরুত্ব জানতে পেরে এই পেশার প্রতি আগ্রহ বাড়ে। পরে ২০০২ সালে আইসিএসবিতে ভর্তি হই। ২০০৬ সালে আইসিএসবি সম্পন্ন হলে পেশা পরিবর্তন করে কোম্পানি সচিব হিসেবে নতুন কর্মজীবন শুরু করি। তাই বলা যায়, কোম্পানি সচিব পেশার দায়িত্ব, কর্তব্য ও উচ্চ পদমর্যাদার জন্য এ পেশার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠি।

প্রশ্ন: প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সচিবের সম্পর্ক কেমন?
মো. জাকির হোসেন এফসিএস: প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোম্পানি সচিব ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পর্ষদ সভায় উপস্থিত থাকার মাধ্যমে কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করতে পারেন কোম্পানি সচিব। কোম্পানি আইন-সংক্রান্ত কোনো আইনি জটিলতা দেখা দিলে কোম্পানি সচিব তার পেশাগত দক্ষতা দিয়ে সমস্যার সমাধান করেন। প্রতিষ্ঠানের একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা হিসেবে কোম্পানি সচিব বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার ও রেগুলেটরি বডির সঙ্গে যোগাযোগ করার পাশাপাশি পরিচালক পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করেন। প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

প্রশ্ন: প্রতিষ্ঠানে একজন দক্ষ কোম্পানি সচিবের ভূমিকা ও গুরুত্ব সম্পর্কে বলুন…
মো. জাকির হোসেন এফসিএস: প্রতিষ্ঠানে কোম্পানি সচিব একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা। প্রতিষ্ঠানে করপোরেট সুশাসন প্রতিষ্ঠা করাই কোম্পানি সচিবের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) সব তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের জন্য কোম্পানি সচিব পদটি বাধ্যতামূলক করেছে। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তির স্বার্থ রক্ষা করা, প্রতিষ্ঠানে আইনকানুন যথাযথভাবে পরিপালিত হচ্ছে কি না সবকিছু কোম্পানি সচিবকে দেখভাল করতে হয়। কোম্পানি সচিবকে কোম্পানি আইনে দক্ষ হতে হয় এবং আইন মোতাবেক কোম্পানিকে পরিচালনা করতে হয়। তাকে প্রতিষ্ঠানের সবকিছু সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে হয়। কোম্পানির ব্যবসা সম্পর্কে ভালোভাবে জ্ঞান রাখতে হয়। প্রতিষ্ঠানের সব বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় রক্ষা করতে হয়। এমনকি প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাগুলো সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখতে হয়। তাই প্রতিষ্ঠানে একজন দক্ষ সচিবের কোনো বিকল্প নেই।

প্রশ্ন: কর্মক্ষেত্রে একজন সচিবের জন্য চ্যালেঞ্জিং বিষয় কী?
মো. জাকির হোসেন এফসিএস: কোম্পানিতে করপোরেট সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে কোনো বিষয়ে অমিল হলে সেগুলো পেশাগত দক্ষতার মাধ্যমে সমাধান করা চ্যালেঞ্জের। শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো রক্ষা করার মধ্যেও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। রেগুলেটরি বডির সব কমপ্লায়েন্স সঠিকভাবে পরিপালন করা, পরিচালনা পর্ষদকে আইনের মধ্যে রেখে যেকোনো সিদ্ধান্ত পরিপালন করা প্রভৃতি একজন সচিবের জন্য চ্যালেঞ্জের।

প্রশ্ন: কর্মক্ষেত্রে সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক ধরে রাখতে আপনার মূলমন্ত্র কী?
মো. জাকির হোসেন এফসিএস: প্রতিষ্ঠানে সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক ধরে রাখার প্রথম ও প্রধান কাজ হলো সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা ও ‘নলেজ শেয়ার’ করা। নানা ধরনের কাজ অধস্তনদের সঙ্গে শেয়ার করে করা, অধস্তনদের কাজ শেখানো প্রভৃতি। এছাড়া ভালোকে ভালো ও মন্দকে মন্দ বলার সাহস থাকতে হবে। সবসময় সব পরিস্থিতিতে সৎ থাকতে হবে। সব বিভাগের সঙ্গে অন্তত প্রতিমাসে একবার মিটিং করে তাদের সমস্যা ও পরামর্শগুলো শুনে সেই মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে হবে। নিজের সম্পর্কে জানতে হবে এবং নিজের দুর্বলতাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

প্রশ্ন: কোম্পানি সচিব পেশাকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
মো. জাকির হোসেন এফসিএস: কোম্পানি সচিব একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা। কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একজন কোম্পানি সচিব। তাকে প্রতিষ্ঠানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয়। প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ পদ্ধতির সঙ্গে তাকে কাজ করতে হয়। এ পেশার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের উন্নতিতে সরাসরি ভূমিকা রাখা যায়। একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানের কোঅর্ডিনেটর, চিফ রেগুলেটরি অফিসার, চিফ কমপ্লায়েন্স অফিসার ও বোর্ডের রিপ্রেজেনটেটিভ হিসেবে অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয়। যেমন বোর্ডের সিদ্ধান্তগুলো প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে অবহিত করে ফিডব্যাক নেওয়া। আবার প্রতিষ্ঠানের বাইরে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করাসহ বিভিন্ন রেগুলেটরি বডির কমপ্লায়েন্সগুলো পরিপালন করতে হয়। কোম্পানি সচিবকে সব পক্ষের মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করতে হয়।

প্রশ্ন: যারা এ পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে চান তাদের উদ্দেশে কিছু বলুন…
মো. জাকির হোসেন এফসিএস: কোম্পানি সচিবের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পেশায় আসতে চাইলে এ পেশায় ক্যারিয়ার গড়ার প্রবল ইচ্ছা থাকতে হবে। অত্যন্ত ধৈর্যশীল হতে হবে। মানুষের সঙ্গে মেশার ইচ্ছা থাকতে হবে। এছাড়া এ বিষয়ে একাডেমিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে। এজন্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশ (আইসিএসবি) থেকে পেশাগত সনদ অর্জন করতে হবে। আইসিএসবি’ই বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান যেখান থেকে এ বিষয়ে পেশাগত ডিগ্রি অর্জন করা যায়।

প্রশ্ন: সফল কোম্পানি সচিব হওয়ার জন্য আপনার পরামর্শ কী?
মো. জাকির হোসেন এফসিএস: কোম্পানি আইনসহ এ পেশার সব সংশ্লিষ্ট রেগুলেটরি বডি, যেমন আরজেএসসি, বিএসইসি ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সব আইনকানুন সম্পর্কে নিজেকে সবসময় আপডেট রাখতে হবে। যোগাযোগে দক্ষ হতে হবে। সময়ের কাজ সময়ে করতে হবে। সৎ হতে হবে। সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হবে।

সৌজন্যে: দৈনিক শেয়ার বিজ

আরও পড়ুন, বিনিয়োগ বেড়েছে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে