বরকতময় রজনী ‘শবে বরাত’

Posted on April 16, 2023

মোহাম্মদ নূরুল মোস্তফা : শবে বরাত ফারসি শব্দ, ‘শব’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে রাত বা রজনী আর ‘বরাত’ অর্থ হল দায়মুক্তি, নিস্কৃতি, অব্যাহতি, পরিত্রাণ ইত্যাদি। ‘শবে বরাত’ অর্থ হল- নিষ্কৃতি বা পরিত্রাণ লাভের রজনী।

শবে বরাতের আরবী প্রতিশব্দ হচ্ছে- ‘লায়লাতুল বরাত’। মর্যাদাসম্পন্ন মাসগুলোর মধ্যে একটি অন্যতম মাস হচ্ছে মাহে শাবান। আর এই মহান শা’বান’র চৌদ্দ তারিখ দিবাগত তথা আজকের রাতই হচ্ছে পবিত্র শবে বরাত। কোরআনুল করীমে এ রাতটিকে লাইলাতুল মোবারাকা বলা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে- “হা-মীম, সুস্পষ্ট কিতাবের শপথ”। আমি সেটাকে বরকতময় রজনীতে অবতীর্ণ করেছি। নিশ্চয় আমি সর্তককারী। তাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ কাজ বিভাজন করে দেয়া হয়। আমার তরফ থেকে নির্দেশক্রমে নিশ্চয় আমি প্রেরণকারী। আপনার পালনকর্তার পক্ষ হতে রহমত, নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞানী। (সুরা আদ্ দুখান- ১-৬)।
শ্রেষ্ঠ মুফাসসির হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাদ্বি:) সহ অধিকাংশ ইসলামী আইন শাস্ত্রবিদ ও মুফাসসিরীনে কেরামদের মতে আয়াতে বরকতপূর্ণ রজনী দ্বারা লায়লাতুম মিন নিসফে তথা শা’বান এর চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত্রিকেই নির্দেশ করা হয়েছে।

যেমন হযরত ইকরামা (রাদ্বি:) বলেন, লায়লাতুল মুরাবারাকা হচ্ছে শা’বান এর মধ্যবর্তী রজনী।

উল্লেখ্য, এই রাতে কিতাব তথা কোরআন করীম নাযিল হওয়ার সূচনার পক্ষে হযরত ইকরামা অভিমত প্রকাশ করলেও ‘জমহুর’ (অধিকাংশ ইসমি) এর মতে পবিত্র কোরআন নাযিলের সুচনা লায়লাতুল ক্বদরেই হয়েছে। অবশ্য অর্ধ শা’বানের এ রাতে অন্যান্য ফযীলতের পক্ষে বহু সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। বিশ্ববিখ্যাত মুফাচ্ছির আল্লামা ইছমাইল হক্কীও (রহ.) লায়লাতুল বরাত ও লায়লাতুল ক্বদরকে স্বতন্ত্র দু’টি রজনী হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যা আমরা তার নিম্নোক্ত উদ্ধৃতি থেকে অনুধাবন করতে পারি। “নিশ্চয় এই রজনীতে আল্লাহর বরকতের চমৎকারিত্য শবে কদরের ন্যায় আরশ হতে জমিনের নিম্নভাগ পর্যন্ত প্রতিটি অণূতে উপনীত হয়”।

প্রিয় নবী (দ.) এ মাসেও দু’আ করতেন যেভাবে রজব মাসে দু’আ করতেন, ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফী রজবা ওয়া শা’বানা ওয়া বাল্লিগনা রামাযান। অর্থ, হে আল্লাহ! আমাদের জন্য রজব ও শা’বান মাসকে বরকতময় করে দিন এবং আমাদেরকে রমজান মাস পর্যন্ত পৌছেঁ দিন। আমীন।’ শা’বান মাসে তিনি অনেকগুলো নফল রোজা রাখতেন। মা আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, “আমি প্রিয় নবী (দ.) কে রমজান ছাড়া আর কোন পূর্ণ মাসের রোজা রাখতে দেখিনি। আর শা’বান মাস ছাড়া আর কোন মাসে এত অধিক পরিমাণ নফল রোজা রাখতে দেখিনি।” (বোখারি ও মুসলিম)

সাহাবী উসামা বিন যায়েদ (রা.) বর্ণনা করেন, আমি প্রিয় নবী (দ.) কে বললাম, “ইয়া রাসুলাল্লাহ (দ.)! শা’বান মাসে আপনি যত নফল রোজা রাখেন অন্য কোন মাসে আপনাকে এত নফল রোযা রাখতে দেখিনা।” প্রিয় নবী (দ.) এরশাদ করলেন, “রজব ও রমজান এ দুটো মাসের মাঝখানের এ মাসটি সম্পর্কে অনেকেই অমনোযোগী হয়ে থাকে। এ মাসে মানুষের আমল (বার্ষিক রিপোর্ট) আল্লাহর কাছে পেশ করা হয়। আমি চাই আমার আমল যখন পেশ করা হয়, আমি যেন তখন রোযা অবস্থায় থাকি।” (আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে খোযাইমা)।

শা’বানের রাতটি এ উপমহাদেশে শবে বরাত নামে পরিচিত। হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রাদ্বিয়ালাহু তায়ালা আনহা হতে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, একদা আল্লাহ পাকের হাবীব হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে কোন এক রাত্রিতে রাতযাপন করছিলাম। এক সময় উনাকে বিছানায় না পেয়ে আমি মনে করলাম যে, তিনি হয়ত অন্য কোন আহলিয়া রদ্বিয়ালাহু তায়ালা আনহা’র হুজরা শরীফে তাশরীফ নিয়েছেন। অতপর আমি তালাশ করে উনাকে জান্নাতুল বাক্বীতে (সাহাবীদের মাযারে) পেলাম। সেখানে তিনি উম্মতের জন্য আল্লাহ পাকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছেন। এ অবস্থা দেখে আমি স্বীয় হুজরা শরীফে ফিরে এলে তিনিও ফিরে এলেন এবং বললেন, আপনি কি মনে করেন আল্লাহ পাকের হাবীব হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপনার সাথে আমানতের খিয়ানত করেছেন? আমি বললাম, ইয়া রসূল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমি ধারনা করেছিলাম যে, আপনি হয়তো আপনার অন্য কোন বিবির হুজরা শরীফে তাশরীফ নিয়েছেন। অতপর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক শা’বানের ১৫ তারিখ রাত্রিতে পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন অর্থাৎ খাস রহমত নাযিল করেন। অতপর তিনি বণী কালবের মেষের গায়ে যত পশম রয়েছে তার চেয়ে বেশী সংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করে থাকেন’। (সুনানে তিরমিযি (২/১২১,১২২), (মুসনাদে আহমাদ ৬/২৩৮)ইবনে মাযাহ, মিশকাত শরীফ)। মধ্য শাবানের রাতে আল্লাহ তাঁর সৃষ্টিলোকের দিকে দৃষ্টি দান করেন এবং সবাইকে মাফ করে দেন কেবল মুশরিক ব্যক্তি ছাড়া ও যার মধ্যে ঘৃণা বিদ্বেষ রয়েছে তাকে ছাড়া। বর্ণনায়, মুয়ায বিন্ জাবাল।

বরাত রজনীর আমল: বরাতের রাত্রিতে ইবাদত-বন্দেগী করে ও পরের দিন রোযা রেখে আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সন্তুষ্টি অর্জন করাই মূল উদ্দেশ্য। নির্দিষ্ট করে না দিলেও হাদীসে ইবাদত-বন্দেগী করার জন্য নির্দেশ করা হয়েছে। হাদীসে আছে,‘হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত।

তিনি বলেন, নবী করিম (দ.) ইরশাদ করেন, শা’বানের ১৪ তারিখ রাত্রি উপস্থিত হলে তখন তোমরা উক্ত রাত্রিতে নামায আদায় করবে এবং দিনে রোযা রাখবে। কেননা নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক উক্ত রাত্রিতে সূর্যাস্তের সময় পৃথিবীর আকাশে আসেন অর্থাৎ খাস রহমত নাযিল করেন। অতঃপর ঘোষণা করেন, ‘কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছো কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দিবো। কোন রিযিক প্রার্থনাকারী আছো কি? আমি তাকে রিযিক দান করবো। কোন বিপদগ্রস্থ ব্যক্তি আছো কি? আমি তার বিপদ দূর করে দিবো। এভাবে ফজর পর্যন্ত ঘোষণা করতে থাকেন।” (ইবনে মাজাহ, মিশকাত)।

হযরত আবু মূসা আশআরী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন নবী করিম (দ.) থেকে বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক শা’বানের ১৪ তারিখ রাত্রিতে ঘোষণা করেন যে, তাঁর সমস্ত মাখলূকাতকে তিনি ক্ষমা করে দিবেন। শুধু মুশরিক ও হিংসা-বিদ্বেষকারী ব্যতীত। (ইবনে মাজাহ, আহমদ, মিশকাত)।

বরাতের নামায: শবে বরাতে ৪, ৬, ৮, ১০, ১২ রাকায়াত নফল নামায পড়া যেতে পারে। তার প্রতি রাকাতে ১বার আলহামদু ও ৩ বা ১০ বার করে সুরা ইখলাস পড়া উত্তম।

সালাতুত তাসবীহ নামায: অতপর সালাতুত তাসবীহ-এর নামায পড়বেন, যার দ্বারা মানুষের সমস্ত পাপরাশি ক্ষমা হয়।

তাহাজ্জুদ নামায: শেষ রাতে তাহাজ্জুদের নামায পড়বেন, যা দ্বারা আল্লাহ পাকের নৈকট্য লাভ হয়।

কোরআন মজীদ তিলাওয়াত: বেশি বেশি কোরআন মজীদ তিলাওয়াত করবেন, যার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জিত হয়। কেননা নফল ইবাদতের মধ্যে কোরআন মজীদ তিলাওয়াত হচ্ছে সর্বোত্তম আমল।

মিলাদ শরীফ ও দরুদ শরীফ পাঠ: মীলাদ শরীফ ও দরুদ শরীফ পাঠ করবেন, যার দ্বারা আল্লাহ পাক ও তাঁর রসূল, সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের সন্তুষ্টি অর্জিত হয়। যিকির-আযকার: যিকির-আযকার করবেন, যার দ্বারা কলবের পরিশুদ্ধতা অর্জিত হয়।

কবর যিয়ারত: কবর যিয়ারত করবেন, বিশেষ করে যাদের মা- বাবা দুনিয়া থেকে চলে গিয়েছেন তারা সহ দাদা-দাদী নানা-নানীসহ আত্মীয় স্বজনের কবর জিয়ারত করা এ রাতের পুণ্যময় আমল। এটি হাদীস দ্বারা স্বীকৃত। এতে যিয়ারতকারীও উপকৃত হয়।।

দান-ছদকা: গরীব-মিসকীনকে সাধ্যমত দান-ছদকা করবেন ও লোকজনদের খাদ্য খাওয়াবেন, যার দ্বারা আল্লাহর বন্ধু হওয়া যায় এবং বিপদাপদ দূর হয়।

দোয়া-ইস্তিগফার: আল্লাহ তায়ালার নিকট বিশেষভাবে প্রার্থনা ও ইস্তিগফার করবেন, যার কারণে মহান আল্লাহ খুশি হবেন। সর্বশেষ খালিস নিয়তে তওবা করবেন, যার মাধ্যমে বান্দাহর সমস্ত পাপরাশি মাফ হয়ে যাবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে পবিত্র এ রজনীর মাহাত্ম অনুধাবন করে পরিপূর্ণ আমল করার তৌফিক দান করুক। আমিন।

লেখক : সাংবাদিক : এমফিল গবেষক, চবি।