নাগরিক সমাবেশে খাসিয়াপুঞ্জির গাছ কাটার পাঁয়তারা বন্ধের দাবি

Posted on February 25, 2023

তিমির বনিক, ষ্টাফ রিপোর্টার: মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় নাগরিক সমাবেশ থেকে ঝিমাই খাসিয়া পুঞ্জির প্রাকৃতিক গাছ কাটা বন্ধের দাবি জানানো হয়েছে। সমাবেশ থেকে গাছ কাটার পাঁয়তারা বন্ধসহ ১২ দফা দাবি জানানো হয়। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে আদিবাসী পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন এই সমাবেশের আয়োজন করে।

দুপুর ১২টায় কুলাউড়া বঙ্গবন্ধু উদ্যানে শুরু হওয়া এই নাগরিক সমাবেশ। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন কুবরাজ আন্তঃপুঞ্জি উন্নয়ন সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি প্রত্যুষ আসাক্রা। এতে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, কুবরাজ আন্তপুঞ্জি উন্নয়ন সংগঠনসহ মোট ১২টি সংগঠন সহযোগিতা করে। সমাবেশে উপজেলার বিভিন্ন খাসিয়া ও গারোপুঞ্জির পাঁচ শতাধিক নারী-পুরুষের আগমন ঘটে। হেলেনা তালাং, মনিকা খংলা ও হেজলা রেমার যৌথ উপস্থাপনায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা।

বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন বাপার সিলেট শাখার সভাপতি ও শাবিপ্রবির সাবেক রেজিস্ট্রার জামিল আহমদ চৌধুরী, প্রথম আলোর উত্তর আমেরিকা সম্পাদক ইব্রাহিম চৌধুরী খোকন, মৌলভীবাজার জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি খন্দকার লুৎফুর রহমান, বাপা জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আব্দুল করিম কিম, শাবিপ্রবির সহকারী অধ্যাপক মাওলানা মো. এমদাদুল হক, বেলা সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়কারী অ্যাড. শাহ শাহেদা, কুলাউড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অরবিন্দু ঘোষ বিন্দু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গৌরা দে, মৌলভীবাজার জেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক মইনুল ইসলাম শামীম, সিলেট আদিবাসী অধিকার সুরক্ষা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব অ্যাড. আবুল হাসান, ব্লাস্ট সিলেটের সত্যজিৎ কুমার দাস, গণজাগরণ মঞ্চ সিলেটের মুখপাত্র দেবাশীষ দেবু, বাপা মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সদস্য সচিব শিবপ্রসন্ন ভট্টাচার্য, কুলাউড়া উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক নির্মাল্য মিত্র সুমন, আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অলিক মৃ, বৃহত্তর সিলেট ত্রিপুরা উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি জনক দেববর্মা ও খাসি স্টুডেন্ট ইউনিয়ন সিলেট শাখার সভাপতি এলিজ্যাক তাংসং।

এতে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন, বাপা কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ফাদার যোসেফ গোমেজ ওএমআই। বক্তব্য রাখেন কুবরাজ আন্তঃপুঞ্জি উন্নয়ন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ফ্লোরা বাবলী তালাং ও ঝিমাই পুঞ্জির মন্ত্রী রানা সুরং।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, উন্নয়নের নামে পুঞ্জির প্রাকৃতিক গাছ কেটে ধ্বংস করা হচ্ছে। আদিবাসীরা চা শিল্প উন্নয়নে বিরোধী নয়। তবে বাগান সম্প্রসারণ কিংবা উন্নয়নের নামে পরিবেশ তথা জনজীবন বিপন্ন করাকে কোনভাবে বরদাস্ত করবে না।
পুঞ্জির মন্ত্রী রানা সুরং বলেন, তাঁদের পুঞ্জিতে ৭২টি খাসিয়া পরিবার থাকে। ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে তাঁরা সেখানে বসবাস করছেন। এর পাশ ঘেঁষেই কেদারপুর টি কোম্পানির মালিকানাধীন ঝিমাই চা-বাগান পড়েছে। ২০১২ সালে সরকার খাসিয়াদের ঐতিহ্যগত ভূমি অধিকার, তাঁদের প্রথাগত জীবনধারা ও অস্তিত্বের বিষয়টি পাশ কাটিয়ে ঝিমাই চা-বাগানের পক্ষে ৬৬১ দশমিক ৫৫ একর ভূমির ইজারা নবায়ন করে ফেলে। ওই ভূমির মধ্যে ঝিমাইপুঞ্জিও পড়ে যায়। এখন চা-বাগান কর্তৃপক্ষ চা-চাষ সম্প্রসারণের নামে ওই ভূমির দুই সহস্রাধিক গাছ কাটার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। গাছ কাটলে পরিবেশের ক্ষতি হবে। খাসিয়ারা জীবন-জীবিকা হারাবেন। মূলত খাসিয়াদের উচ্ছেদের উদ্দেশে এ অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।

বক্তারা বলেন, এমনিতেই বনের পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। বাঁশমহাল ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রাকৃতিক গাছপালা আগের মতো নেই। সামাজিক বনায়নের নামে প্রভাবশালীরা বন দখলে নিয়ে নিচ্ছেন। অথচ খাসিয়ারা বন-প্রকৃতিকে ভালোবাসেন। বন-প্রকৃতিকে ঘিরেই তাঁদের স্বাভাবিক নিয়মে জীবন-জীবিকার মাধ্যম। তাঁদের মমতায় বনের গাছগাছালি রক্ষা পাচ্ছে। সেখানে চা-বাগান সম্প্রসারণের নামে খাসিয়া পুঞ্জির প্রাকৃতিক গাছ কেটে ফেলার পাঁয়তারা চলছে। এ অপচেষ্টা রুখতে হবে।

সমাবেশে ঝিমাই খাসিয়াপুঞ্জির গাছ কাটার পাঁয়তারা বন্ধ, পুঞ্জির যাতায়াতের রাস্তায় চা-বাগান কর্তৃপক্ষের সব বাঁধা অপসারণ, কেদারপুর টি কোম্পানির ইজারা বাতিল করে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের ভোগদখলীয় ভূমির স্থায়ী বন্দোবস্ত প্রদান, ডুলুকছড়া, বেলকুমা, নুনছড়াসহ বিভিন্ন পুঞ্জির ক্ষুদ্র জাতিসত্তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, খাসিয়া পান চাষকে ‘বিশেষ কৃষি ঐতিহ্য’ ঘোষণা, সামাজিক বনায়নের আড়ালে প্রভাবশালী ভূমিখেকোদের আশ্রয়-প্রশ্রয় বন্ধ, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ভোগদখলীয় ভূমিতে সামাজিক বনায়ন প্রকল্প গ্রহণ না করা, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিশুদ্ধ পানি, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, পৃথক ভূমি কমিশন গঠন, খাসিদের জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা প্রদান, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সব সনদসহ আইএলও কনভেনশন ১০৭ বাস্তবায়নের দাবি জানানো হয়।

বক্তারা আন্দোলনকারীদের ১২ দফা দাবির প্রতি একাত্মতা পোষণ করে বলেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের উন্নয়ন সম্ভব নয়। তারা অবিলম্বে পুঞ্জির প্রাকৃতিক গাছ কাটার পাঁয়তারা বন্ধ করে পুঞ্জিবাসীর যাতায়াতে সকল বাঁধা অপসারণের দাবি জানান তারা।