শেয়ারবাজারে আবারও তেজিভাব। অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে কিছু কোম্পানির। বাজারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে সঙ্গে কথা বলেছেন পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী।
প্রশ্ন: শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক উত্থানকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী: বাজারের লেনদেন ও সূচক যে পর্যায়ে নেমে গিয়েছিল, তাতে করে সূচক ও লেনদেন বৃদ্ধির যথেষ্ট সুযোগ তৈরি হয়েছিল। তিন-চার মাস ধরে বাজারে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরে আসে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থাও বেড়েছে। তাতে সূচক ও লেনদেন বাড়তে শুরু করে। দীর্ঘদিন প্রতীক্ষার পর বাজারের জন্য সেটা বেশ ভালো দিক ছিল। কিন্তু শেষ দুই সপ্তাহ বা তার কিছুটা বেশি সময় ধরে বাজারের যে উত্থান আমরা দেখছি, সেটিকে একটু দ্রুতই মনে হচ্ছে। এরপর গত দুদিন বাজারে কিছুটা মূল্য সংশোধন হয়েছে, সেটিকে বাজারের জন্য ভালো মনে হয় আমার কাছে। কোনো রকম মূল্য সংশোধন ছাড়া বাজার একটানা বেড়ে যাবে, এটা বেশ দুশ্চিন্তার। তবে বাজার বৃদ্ধির সুযোগ আছে।
প্রশ্ন: প্রায়ই দেখা যায়, বাজার যখন বাড়তে থাকে তখন একটানা বাড়ে, আবার কমলেও একটানা কমতে থাকে। এটি কেন?
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী: সামগ্রিকভাবে আমাদের বাজারের বেশ কিছু দুর্বলতা রয়েছে। এ কারণে যখন বাড়তে থাকে তখন বেড়েই চলে। একইভাবে কমতে থাকলে একটানা কমে। কিন্তু বাজারের সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়া। তাতে বাজার অনেক বেশি টেকসই হয়। কিন্তু হঠাৎ করে একটানা বেড়ে যাওয়াটা আমার মনে হয় কিছুটা উদ্বেগের কারণ। তবে বর্তমানে সূচক যেখানে রয়েছে, সেটিকে আমার স্বাভাবিকই মনে হয়। এ পর্যায়ে সূচক নিয়ে উদ্বেগের কোনো কারণ আমি দেখি না। আমাদের বাজারের আরেকটি বড় দুর্বলতা দুর্বল মৌল ভিত্তির কোম্পানির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। দেখা যাচ্ছে, ভালো কোম্পানির তুলনায় দুর্বল কোম্পানির শেয়ারের দাম অত্যন্ত দ্রুত বাড়ছে। এটাতে সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। বিনিয়োগকারীদের মনে রাখতে হবে, শেয়ারের দাম যত বাড়বে, ঝুঁকিও তত বাড়বে।
প্রশ্ন: দুর্বল মৌল ভিত্তির কোম্পানির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে কোনো কারসাজি রয়েছে বলে মনে করেন কি?
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী: দেখুন, পৃথিবীর কোনো বাজারই পরিপূর্ণ কারসাজিমুক্ত নয়। সেখানে আমাদের মতো অগভীর ও ছোট বাজারে কারসাজির সুযোগ খুব বেশি। তাই বলা যায় না আমাদের বাজারও কারসাজিমুক্ত হয়ে গেছে। তবে কারসাজির সুনির্দিষ্ট ঘটনা আমাদের চেয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাই বেশি বলতে পারবে। কারণ, বাজার তদারকির দায়িত্ব তাদের। তবে বাইরে থেকে আমরা যেটা বলতে পারি তা হলো, দুর্বল কোম্পানির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে কিছু কারসাজি থাকলে থাকতেও পারে। আবারও না-ও হতে পারে। যেহেতু বাজার তদারকির ব্যবস্থার সঙ্গে আমি যুক্ত নই, তাই এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারছি না। তবে আমাদের বিনিয়োগকারীদের মানসিকতায় এমন ছোট ও কম দামি কোম্পানির শেয়ারের দাম সামান্য বাড়লে তাতে লাভের পরিমাণ অনেক বেশি বলে তাঁরা স্বল্প মূলধনি ও কম দামি শেয়ারের প্রতি বেশি ঝোঁকেন।
প্রশ্ন: দুর্বল কোম্পানির আধিপত্য কমাতে বাজারে ভালো কোম্পানির সংখ্যা বাড়ানো দরকার বলে সব সময় বলা হয়। কিন্তু গত কয়েক বছরে ভালো কোম্পানিকে খুব বেশি কি বাজারে আনা সম্ভব হয়েছে?
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী: না। গত কয়েক বছরে বাজারে উল্লেখ করার মতো ভালো কোনো কোম্পানি আসেনি। পুরোনো ভালো কোম্পানিগুলোই ঘুরেফিরে রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি কোনো খাতের ভালো কোম্পানিকে নতুন করে বাজারে আনতে ব্যর্থ হয়েছি আমরা সবাই।
প্রশ্ন: কেন ভালো কোম্পানি বাজারে আনা সম্ভব হচ্ছে না?
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী: সরকারি কিছু কোম্পানির বাজারে তালিকাভুক্তির বিষয়ে সরকারের দিক থেকে সুস্পষ্ট ঘোষণা ছিল। সেটি কেন বাস্তবায়িত হচ্ছে না, তা সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে খতিয়ে দেখা দরকার। সরকারি মালিকানায় ছয় থেকে সাতটি ভালো কোম্পানি রয়েছে, যেগুলো বাজারে এলে বাজারের গভীরতা বৃদ্ধি পেত। সরকারি কোম্পানিগুলো বাজারে এলে দুটো সুবিধা হয়। একদিকে বাজারের গভীরতা বাড়ে, অন্যদিকে কোম্পানিগুলোর আর্থিক স্বচ্ছতা ও সুশাসন বাড়ে। আর বেসরকারি খাতের ভালো কোম্পানি বাজারে না আসার পেছনে বড় কারণ উদ্যোক্তাদের অনাগ্রহ। কারণ, বাজারে এলে কোম্পানিতে স্বচ্ছতা আনতে হবে, করের ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ম মেনে চলতে হবে। তাই যেখানে ব্যাংকে গেলেই টাকা পাওয়া যায়, সেখানে নিয়মনীতির আওতায় শেয়ারবাজারে আসার ক্ষেত্রে অনেকের আগ্রহ কম।
প্রথম আলো: কোম্পানিগুলোর আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে তাহলে করণীয় কী?
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী: কোম্পানির আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যথাযথ আর্থিক বিবরণী প্রস্তুত ও নিরীক্ষা। এখানেই আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি গলদ। শুধু তালিকাভুক্ত কোম্পানির বেলায় যথাযথ আর্থিক বিবরণী ও নিরীক্ষার ব্যবস্থা করলে চলবে না, সব ধরনের কোম্পানির বেলায় এটি বাধ্যতামূলক করা দরকার। অথচ আইন হওয়ার পরও ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল গঠন করার তেমন কোনো উদ্যোগ এখনো আমাদের চোখে পড়ছে না। কাউন্সিলটি গঠন করা খুব জরুরি। আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা আনতে হলে এটির কোনো বিকল্প নেই।
প্রশ্ন: শেয়ারবাজারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়াতে স্টক এক্সচেঞ্জের ডিমিউচুয়ালাইজেশন করা হয়েছে। আপনি কি মনে করেন, সেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে?
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী: আমি মনে করি, আমাদের এখানে প্রকৃত অর্থে কোনো ডিমিউচুয়ালাইজেশন হয়নি। একমাত্র পার্থক্য যেটা হয়েছে সেটা হলো, পরিচালনা পর্ষদে কিছু পরিবর্তন এসেছে। যেখানে স্বতন্ত্র পরিচালকের সংখ্যা বেড়েছে। সেসব পরিচালকও আবার নির্বাচিত হয়েছেন ব্রোকারদের পছন্দে। এ ছাড়া ব্রোকারদের নামের কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। আগে যাঁরা সদস্য ছিলেন, তাঁরা এখন শেয়ারধারী হয়েছেন। এর বাইরে তো আর কোনো বড় পরিবর্তন দেখি না। ডিমিউচুয়ালাইজেশনের অন্যতম লক্ষ্যই হচ্ছে মালিকানা ও লেনদেনের অধিকারকে (ট্রেডিং রাইটস) আলাদা করা। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমাদের এখানে যাঁরা মালিক তাঁরাই ট্রেডার।
সৌজন্যে: প্রথম আলো।
© ২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | কর্পোরেট সংবাদ সম্পাদক - মোঃ মিজানুর রহমান । উপদেষ্টা সম্পাদক- জেসমিন আক্তার, এফসিএস ই-মেইলঃ corporatesangbad@gmail.com । ফোনঃ ০২২২-৩৩৫৪১২৫ । মোবাইলঃ ০১৭১১০৭৬৮১৫ অফিসঃ ৫৫/বি, নোয়াখালী টাওয়ার, ১১ তলা, সুইট ১১-এফ, পুরানা পল্টন, ঢাকা ১০০০ |
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী, সাবেক চেয়ারম্যান, বিএসইসি https://corporatesangbad.com/13715/ |