উন্নয়ন ও গণতন্ত্র অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত: ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ

Posted on January 18, 2017

প্রশ্ন: সরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) গত পাঁচ-ছয় বছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। কিন্তু এডিপির অর্থ খরচ হলেও অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটছে না আশাব্যঞ্জকভাবে। এর কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?

ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ: বিনিয়োগ কোন খাতে কত সময়ব্যাপী করা হবে, এটা গুরুত্বপূর্ণ। আবার কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধিতে এর প্রভাব কীভাবে পড়বে, সেটাও জরুরি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে গত কয়েক বছরে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ অত্যন্ত কম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগের অনুপাত জিডিপির ২১-২২ শতাংশের বেশি নয়। সরকারি বিনিয়োগ মিলে তা ২৮-২৯ শতাংশ। অর্থাৎ মূল প্রবৃদ্ধিটা সরকারি খাতের। ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে কিছু মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এ ধরনের প্রকল্প প্রচুর ব্যয়সাপেক্ষ। সমস্যা হচ্ছে, এ ধরনের বড় বড় প্রকল্পে তাৎক্ষণিক আউটপুট আসে না। এ কারণে অর্থের সরবরাহ বেড়ে যায়। মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে খুব বেশি লাভ হয়, তাও না। মেগা প্রকল্পের প্রয়োজন আছে। কিন্তু এর সংখ্যা অত্যধিক হলে প্রত্যক্ষ ও তাৎক্ষণিক ফল আসে না। হয়তো বেশ কয়েক বছর পর কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধিতে লাভ হতে পারে। দ্বিতীয়ত, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যায় (কস্ট ওভাররান)। প্রকল্পের গুণগত মান ঠিক থাকে না। দুর্নীতি ঘটারও সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া এডিপি বাস্তবায়নের হার অনেক মন্ত্রণালয়ে বেশ কম। কাজে দক্ষতার অভাব, রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ এর কারণ।

আমার মতে, সরকারি বিনিয়োগ এতটা বাড়ানো ঠিক নয়। ফলে বিরাট একটা বাজেট ঘাটতি হয়। যার বোঝা ব্যাংকিং খাতকে বহন করতে হয়। সঞ্চয়পত্র অথবা বাইরে থেকে ঋণ নিয়ে পোষানো হয় এ ঘাটতি। মাথাপিছু ঋণের বোঝা আমাদের ওপর দিন দিন বাড়ছে। গত কয়েক বছরে বেসরকারি বিনিয়োগে স্থবির অবস্থা বিরাজ করছে। পছন্দ করুন আর নাই করুন, আমাদের অর্থনীতির ভিত্তিই হচ্ছে বেসরকারি খাত। তারাই পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করে, তারাই কর্মসংস্থান করে। তারাই নতুন নতুন প্রযুক্তি আনে। ব্যবসা-বাণিজ্যে বেসরকারি খাতেই প্রবৃদ্ধি বেশি। সেখানে বিনিয়োগের পরিমাণটা ঠিক নয়। এর কারণ প্রধানত রাজনৈতিক পরিস্থিতি। সম্প্রতি রাজনীতিতে অস্থিরতা কমলেও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। সার্বিকভাবে আমাদের বিনিয়োগ যদি ৩২ শতাংশে না নিতে পারি, তাহলে আমাদের সাড়ে ৭ অথবা ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। সুতরাং বেসরকারি বিনিয়োগ আনাটাই আমাদের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

প্রশ্ন: বর্তমানে আমাদের রাজস্ব বাজেটের ২৫ শতাংশ ঋণ শোধ করতে চলে যায়। এই যে ঋণ বাড়ছে, এটা আগামী দিনে অর্থনীতিতে কোনো ঝুঁকি তৈরি করবে কি না?

ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ: ঋণ শোধ করার ক্ষমতা নিয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। এখন ডলারের বিপরীতে টাকার মান যা আছে; ভবিষ্যতে টাকার মান দুর্বল হয়ে ১০০ টাকা হয়ে গেলে প্রকৃত সুদের হার (ইফেক্টিভ রেট অব ইন্টারেস্ট) বাড়বে অর্থাৎ ঋণের বোঝা আরও বাড়বে। সেজন্য যতটুকু সম্ভব কমিয়ে ঋণ নেওয়া উচিত।
আমার মতে, এডিপিতে থাকবে অল্প প্রকল্প। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা ও ভৌত অবকাঠামো ছাড়া বহু প্রকল্প নিয়ে বিরাট আকারের এডিপি করার দরকার নেই। ছোটখাটো অনেক প্রকল্প আছে, যার কোনো প্রভাব নেই। ভারত-চীন থেকে যে ঋণ নেওয়া হয়, তাতে অনেকগুলো শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। এতে যারা ঋণ দেয় তাদের সুবিধা বেশি থাকে। আমার মনে হয় এদিকে একটু নজর দেওয়া উচিত। সর্বোপরি আমি বলবো, আমাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনা (ফিসক্যাল ম্যানেজমেন্ট) অত্যন্ত দুর্বল ও ত্রুটিপূর্ণ।

প্রশ্ন: সম্প্রতি রফতানি আয় কমে যাওয়ার কারণে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা বলছেন অনেকে। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?

ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ: বিনিময় হার একটু যৌক্তিক করা প্রয়োজন। বর্তমানে চলতি হিসাব নেতিবাচক হয়ে গেছে। অর্থাৎ আমাদের রফতানির চেয়ে আমদানি বেড়ে গেছে। এটা বেশিদিন চলতে থাকলে টাকার মূল্যমানের ওপর প্রভাব ফেলবে। এই যুক্তিতে অনেকে বলছে, এটা বেশিদিন চলতে দেওয়া যাবে না। রফতানি বাড়াতে হলে টাকার অবমূল্যায়ন কিছুটা করতে হবে। এটা প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রেও কিছুটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। অবৈধ পথে না এসে বৈধ উপায়ে আসার মাত্রা বাড়বে। তবে এটা একটু চিন্তাভাবনা করে করা উচিত। অবমূল্যায়ন করলে হিসাব করে দেখতে হবে, রফতানি ও রেমিট্যান্স কতটা বাড়ছে। অর্থাৎ টাকার মান ৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন করা যেতে পারে। এতে রফতানি আয় যদি ১ শতাংশ বাড়ে আর রেমিট্যান্স যদি দশমিক ৫০ শতাংশ বাড়ে, তাহলে অবমূল্যায়নটা যৌক্তিক হবে না। বরং এতে আমদানি খরচ বেড়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে আমদানিকারকরা ভুক্তভোগী হবেন। এটার ভারসাম্য বজায় রাখার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংককে সতর্ক থাকতে হবে।

প্রশ্ন: আপনি বলছিলেন ফিসক্যাল ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থাটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। প্রতিবছর রাজস্ব আয়ের একটা বড় লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়। কিন্তু তা পূরণ হয় না। তাহলে এ ধরনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ কতটা যৌক্তিক?

ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ: রাজস্ব আয়ের দিকটা অর্থাৎ ট্যাক্স রেভিনিউ আমাদের খুবই কম। অন্যান্য দেশের কথা বাদ দিলাম, এটা এমনকি নেপালের চেয়েও কম। এর কারণ আমাদের পরোক্ষ কর যেমন ভ্যাট এবং অন্যান্য পরোক্ষ কর ও চার্জের ওপর নির্ভরশীলতা বেশি। ফলে ক্রেতা ও সাধারণ মানুষ বেশি ভুক্তভোগী হন। উচিত প্রত্যক্ষ কর আদায়ে মনোযোগী হওয়া। প্রত্যক্ষ করের ব্যাপারে সমস্যা হচ্ছে, এখানে দুর্নীতি বেশি হয়। করের হার না বাড়িয়ে করদাতার সংখ্যা বাড়ানো দরকার। যে লোকগুলোর ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার (টিন) আছে, তারা যদি ঠিকমতো ট্যাক্স দেয়, তাহলে বিরাট অঙ্কের আয় বেড়ে যাবে। এ জিনিসটাই আমাদের দেশে ভালোভাবে হচ্ছে না। এখানে সমস্যা হচ্ছে, যারা ট্যাক্স আদায় করে, তাদের স্বচ্ছতা নেই। এছাড়া পরোক্ষ কর আদায়ের ক্ষেত্রেও ত্রুটি আছে।

প্রশ্ন: গত তিন-চার বছর ধরে মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের জন্য যে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়, তা ঠিকমতো অর্জন হয় না। এটার ধারাবাহিকতা এ বছরের প্রথমার্ধেও হয়তো চলবে। এর কারণ কী?

ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ: মুদ্রানীতি একসময় প্রকাশ করা হতো না। ২০০৬ সালের জানুয়ারি থেকে এটি প্রকাশের রীতি চালু হয়। আমি নিজেই এটি চালু করেছিলাম। সে সময় থেকেই সরকারি ও বেসরকারি খাতে ঋণ বণ্টনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দেওয়ার প্রথাটি চালু হয়। এখন যেটা করা দরকার তা হলো, কীভাবে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা হবে, তাও নির্ধারণ করে দেওয়া। আমরা ভারতীয় মুদ্রানীতি দেখি, তারা লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কী কী করা উচিত, তা নিয়ে অনেক বেশি বিশ্লেষণ করে। আমাদের মুদ্রানীতিতেও সেটি আনতে হবে।

প্রশ্ন: আগামী ২৪ জানুয়ারি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হবে। এ মুদ্রানীতির লক্ষ্যটা কী হওয়া দরকার বলে মনে করেন?

ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ: আমাদের বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি বেশ কম, মাত্র ১৪ শতাংশ। সেটা আরেকটু বাড়ানো যায়। আমি চাচ্ছি, সংকুলানমুখী হোক দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি। মুদ্রানীতি সংকুলানমুখী করলে মূল্যস্ফীতির একটা চাপ আসে। কারণ ঋণ প্রবৃদ্ধি হলে চাহিদা বাড়বে, লোকজনের হাতে টাকা-পয়সা যাবে। প্রধান ব্যাপারটা হচ্ছে, কোন খাতে টাকাটা যাচ্ছে? বড় বড় ইন্ডাস্ট্রিকে ঋণ দিলে সেটার পুনরুদ্ধারের হার (রিকভারি রেট) কম। আমি মনে করি, মুদ্রানীতিতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ প্রদানে সুবিধা প্রদান করা উচিত। একজনকে ১০০ কোটি টাকা দেওয়ার চেয়ে এক কোটি টাকা করে ১০০ জনকে ১০০ কোটি টাকা দেওয়া ভালো। এখানে কর্মসংস্থানের ব্যাপার আছে। ১০০ জন উদ্যোক্তা দু’জন করে হলেও ২০০ জনকে কর্মসংস্থান দেবে। অন্যদিকে একজন উদ্যোক্তাকে ১০০ কোটি টাকা দিলে এবং পুঁজিঘন শিল্প হলে কর্মসংস্থান ও সাধারণ মানুষের আয়ের উৎস বৃদ্ধি পাবে না। ছোট অঙ্কের ঋণের চাহিদা প্রচুর। সে তুলনায় সরবরাহ হচ্ছে না। এই যে আমরা বলছি ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশনের কথা, কিন্তু বহু লোকই ব্যাংক লোন পায় না। বিশেষ করে ঢাকা-চিটাগংয়ের বাইরে ঋণসেবা পাওয়ার সংখ্যা খুবই নগণ্য। ব্যাংকারদের এখন উচিত নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করা এবং যারা নতুন সৃষ্টি হয়েছে তাদের ঋণ দিয়ে ব্যবসা বৃদ্ধিতে সহায়তা করা। যেটা মাইক্রো ক্রেডিটে করা হয়। ১০ হাজার থেকে ৫০ হাজার, ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ। এগুলো মুদ্রানীতিতে আসা দরকার। তার মানে একজনের প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করা, একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি করলে বিনিয়োগ বাড়বে না। বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান হবে না। প্রবৃদ্ধিও বাড়বে না। সুতরাং এগুলোর মধ্যে ভারসাম্য আনতে মূল্যস্ফীতি যদি কিছুটা বেড়েও যায়, তবু লোকজনের ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলে এটা ক্ষতিকর হবে না। যদি আয়ই না থাকে, মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনলেও লাভ হবে না। সুতরাং মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার পরিকল্পনায় বেশি গুরুত্ব দিলে কোনো লাভ হবে না। প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং সমতাভিত্তিক অর্থায়নের সুযোগÑ এগুলোর মধ্যে সমন্বয় করতে হবে।

প্রশ্ন: খেলাপি ঋণ ও অর্থ জালিয়াতি বেশ কয়েক বছরে ব্যাংকিং সেক্টরকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এ ব্যাপারে আপনার কী মত?

ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ: ব্যাংক খাতের এখন চরম দুরবস্থা। দুর্নীতি, বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতার অভাব পুরো ব্যাংকিং খাতকেই প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। দুর্নীতি শনাক্ত হলেও শাস্তি হচ্ছে না। এটা আরও বেশি খারাপ হচ্ছে। এর ফলে ডোমিনো এফেক্টে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোকেও দুর্নীতির সংস্কৃতি প্রভাবিত করছে। ধরা পড়লেও শাস্তি হচ্ছে না, দুর্নীতি করলে কোনো অসুবিধা নেই। মন্দ ঋণ মাঝখানে কিছুদিন নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এখন আবার বাড়ছে। তার কারণ এই শাস্তি না হওয়া। আবার রাজনৈতিক প্রভাবে যেসব ঋণ দেওয়া হচ্ছে, সেগুলোর জামানতের গুণগত মান ঠিকমতো যাচাই না করে বণ্টন করা হচ্ছে। আমি অনেককে জানি যারা ব্যাংক থেকে টাকা নিয়েছে ব্যবসা করবে বলে, কিন্তু দামি ফ্ল্যাট-গাড়ি কেনায় সেটা ব্যয় করেছে। এরা তো স্বাভাবিকভাবেই ঋণ শোধ দিতে পারবে না। এ সংস্কৃতি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।

প্রশ্ন: ব্যাংকিং খাতের সংস্কারে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যায়?

ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ: প্রথম দরকার ব্যাংকিং খাতকে রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রের প্রভাব থেকে পুরোপুরি মুক্ত করা। পরিচালনা পর্ষদে বসে সরাসরি রাজনীতি করার সংস্কৃতি বদলাতে হবে। দ্বিতীয়ত, দক্ষ লোক নিয়োগ করতে হবে। ব্যাংকের সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যায়ে দক্ষ লোকের অভাব আছে। আবার কিছু দক্ষ লোক থাকলেও তাদের ঠিকমতো ব্যবহার করা হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের যে নিয়মনীতি আছে, তা মোটামুটি আন্তর্জাতিক মানের। কিন্তু বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সেগুলো ঠিকমতো পরিপালন করে না। পরিপালন না করার কারণে যে শাস্তি হওয়ার কথা, সেটা হয় না। সুতরাং কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্ত একটা অবস্থান নিতে হবে। এদিকে ব্যাংকিং বিভাগের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এক্ষেত্রে পরিচালক, চেয়ারম্যান নিয়োগ দিচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। অনেক ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুপারিশ সঠিকভাবে গ্রহণ করা হচ্ছে না। এটা শক্ত অবস্থান গ্রহণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য একটা সমস্যা। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ক্ষমতা দিতে হবে।

প্রশ্ন: বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সাম্প্রতিক যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, চেয়ারম্যানরা দীর্ঘদিন থাকার জন্য লবিং করছেন। এটা হতে দেওয়া উচিত কি না?

ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ: আমার মতে, এটা ঠিক নয়। একজন একেবারে সারাজীবন থেকে যাবেন, এটা কাম্য নয়। ব্যাংক অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে আলাদা। ব্যাংকের সমস্ত ক্যাপিটাল পরিচালনা পর্ষদের নিজস্ব সম্পত্তি না। ডিপোজিটর বলে আরেকটি পার্টি আছে। তারা ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করে না; কিন্তু তারা স্টেকহোল্ডার। অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ‘ফাইন্যান্সিয়াল রুল’ আছে। কিন্তু ব্যাংকের ক্ষেত্রে আরও রয়েছে ‘প্রুডেনশিয়াল নরম্স’। এতে বলে দেওয়া থাকেÑ কত টাকা কাকে দেবেন, কীভাবে দেবেন না। এটা বলে দেওয়া যে, টাকাগুলো তোমার না। এজন্যই সারাজীবন বা বেশিদিন পদে থাকলে ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে একটা আঁতাত তৈরি হয়ে যেতে পারে। এতে দুর্নীতি বৃদ্ধি পেতে পারে। তাই ব্যাংকের সুশাসনের দিক দিয়ে এটা কাম্য নয়।
একজন চেয়ারম্যান আজীবন থাকলে নতুন নতুন আইডিয়া আসবে না। একই বৃত্তে সৃষ্টিশীলতা আটকে যেতে পারে। এছাড়া পরে তাদের আবার নির্বাচিত হয়ে আসার সুযোগ আছে। এতে ব্যাংকের নেতৃত্বে নতুনত্ব আসবে। নতুন নতুন আইডিয়াও আসতে পারে।

প্রশ্ন: বাংলাদেশে পরিচালিত বিদেশি ব্যাংক ব্যবস্থাপনা নিয়ে আপনার মতামত কী?

ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ: বহুজাতিক ব্যাংকগুলোর অবস্থা ভালো। আন্তর্জাতিক নিয়ম থাকার কারণে তারা আর্থিক শৃঙ্খলা যথাযথ বজায় রাখে। তাদের আন্তর্জাতিক মান মেনে চলতে হয়। তবে তাদের ঋণের সুদের স্প্রেড বেশি। তাদের কস্ট অব ফান্ড অনেক কম, তবে সুদের হার অন্যান্য ব্যাংকের তুলনায় কম নয়।
বিদেশি সংস্থা, বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানির টাকা ওখানে থাকে। এসব গ্রাহক সুদের হার নিয়ে খুব বেশি দরকষাকষি করে না। তারা হাজার হাজার কোটি টাকা রাখে। ফলে সেখানে কস্ট অব ফান্ড খুব কম। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত তাদের স্প্রেড কিছুটা কমানোর জন্য চাপ দেওয়া। তারা আরও কম হারে ঋণ দিতে পারে, কিন্তু দেয় না। কারণ তারা জানে, তাদের বিকল্প নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি দেশীয় ব্যাংকগুলোর সেবার মান উন্নত করতে না পারে, তাহলে কঠিন হবে দেশের ব্যাংকগুলোর টিকে থাকা, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ক্ষেত্রে। আমাদের ব্যাংকগুলোর একটি বড় দুর্বলতা ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট ও ক্যাপিটাল ইরোসন। তারপর রয়েছে দুর্নীতি। ফলে আমদানিকারকরা এলসি খোলার ব্যাপারে বাংলাদেশের অনেক ব্যাংককে পছন্দ করে না। তারা বলে দেয়, এই ব্যাংকে এলসি খুলো না। তারা জানে, দেশের কোন ব্যাংকের কী অবস্থা। রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক দেওয়া হচ্ছে। নতুন অনেক দেশীয় ব্যাংক এলসিও খুলতে পারে না। তাদের কাউন্টার গ্যারান্টি নিতে হয় বহুজাতিক ব্যাংকগুলো থেকে। একটা ফিস দিয়ে বহুজাতিক ব্যাংকগুলোকে গ্যারান্টার হিসেবে নেয়। দেশের ব্যাংকগুলো স্ট্যান্ডার্ড মেনে চলে না দেখেই এমনটা হয়।

প্রশ্ন: পরিচালনা পর্ষদে ইসলামী ব্যাংকের সাম্প্রতিক রদবদল নিয়ে আপনার মতামত কী?

ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ: কেন পরিবর্তন হয়েছে, কী উদ্দেশ্যেÑ সব পরিষ্কার থাকলে জনগণের কাছে এত গুজবের অবকাশ থাকত না। এই রদবদলের মূল কারণগুলো আমরা জানি না। দ্বিতীয়ত, এ পরিবর্তনের ফলে সেবার মান, ব্যাংকের পারফরম্যান্স, প্রফিট, অপারেটিং কস্ট এগুলোর যদি কোনো উন্নতি না হয়, তখন এটা নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ডোন্ট ফিকস এনিথিংক হুইচ ওয়ার্কস ওয়েল। একটা মেশিন চলতে থাকলে সেটা খুলে বেশি করে ঠিক করার দরকার দেখি না। যেটা চলছে, সেটাকে চলতে দিতে হয়। দেখা যাক, এ ব্যাংকের দক্ষতা ও সেবার গুণগত মান বাড়ে কি না। এটি এমনিতে একটা বৃহৎ ব্যাংক। রেমিট্যান্স এ ব্যাংকেই সবচেয়ে বেশি আসে। আরও যদি বাড়ে, তাহলে বোঝা যাবে পরিবর্তনটা ভালো হয়েছে। না হলে তো প্রশ্ন থেকেই যাবে, পরিবর্তনটা কেন হয়েছে।

প্রশ্ন: আপনার অভিজ্ঞতায় স্বাধীনতার পর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবচেয়ে বড় অর্জনকোনটি? আর কোন জায়গায় যেতে পারতো, কিন্তু পারেনি?

ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটা ধারাবাহিকতা থাকতে হয়। আমি মনে করি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেটা রাখতে মোটামুটি সক্ষম হয়েছে। এজন্য ব্যাংকিং খাত সবচেয়ে বেশি সুশৃঙ্খল অবস্থায় ছিল, যদিও গত চার-পাঁচ বছর ধরে এই শৃঙ্খলায় কিছু ঘাটতি দেখা যায়। তবুও আমি বলবো, অন্যান্য খাতের তুলনায় ব্যাংকিং খাতের অবস্থা এখনো ভালো। কারণ অন্যান্য জায়গায় কী হচ্ছে না হচ্ছে, জনগণ ততটা অবগত নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতায় সরকার বা অর্থ বিভাগ খুব একটা হস্তক্ষেপ করে না। সঠিকভাবে যথাসময়ে পদক্ষেপ নেওয়ার মূল দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। এ বিষয়ে নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি নেওয়া ঠিক নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শক্ত অবস্থান সম্প্রতি কিছুটা দুর্বল হয়েছে। কারণ গত কয়েক বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার মূল দায়িত্ব অর্থাৎ নিয়মনীতি পরিপালন নিশ্চিত করার জায়গা থেকে কিছুটা সরে এসে আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয় নিয়ে ব্যস্ত ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংক থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের। কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সরাসরি উন্নয়ন প্রকল্পে সাধারণত নিয়োজিত হয় না। রাষ্ট্রীয় ব্যাংকে কেলেঙ্কারি, সুশাসনের অভাব আর সর্বশেষ যেটা রিজার্ভ চুরি- সব মিলিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভাবমূর্তি কিছুটা ক্ষুন্ন করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রিজার্ভ চলে যাওয়া কোনো সাধারণ বিষয় নয়। হতে পারে সেটা হ্যাকিং, কিন্তু এর পেছনে নিশ্চয় কিছু ব্যবস্থাপনা, সুশাসন ও নিয়ন্ত্রণের দুর্বলতা ছিল। এর পরে এই রিজার্ভ পুনরুদ্ধার নিয়ে দ্বিধান্বিত অবস্থান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভাবমূর্তি আরও ক্ষুন্ন করেছে।  রিজার্ভ চুরির ক্ষেত্রে সাইবার সিকিউরিটিতে দুর্বলতা ছিল। প্রযুক্তিই যথেষ্ট নয়, এটি ব্যবহার করে মানুষ। তাই প্রযুক্তি ব্যবহারকারীর প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। সাইবার ব্যবস্থাপনা আরও সুপরিকল্পিত ও দক্ষ করা দরকার।

প্রশ্ন: সর্বোপরি আপনার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির শক্তিশালী ও দুর্বল দিক কোনটি?

ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ: সামগ্রিক অর্থনীতির সূচকগুলোয় অর্জন ভালো। আমরা প্রবৃদ্ধির ৬-এর বৃত্ত থেকে বেরিয়ে গেছি। এটা ইতিবাচক। সার্বিক উন্নতি সন্তোষজনক। এজন্য বাংলাদেশ একটা মডেল। দুর্বল দিকটা হলো, অর্জনের এ ফলগুলো সমাজের নিচের স্তরে অপেক্ষাকৃত খুব কম পৌঁছেছে। ধরুন ধনাঢ্য শ্রেণি, যারা আগে একটা গাড়িতে চড়ত, তারা এখন একাধিক গাড়িতে চড়ছে। গরিব লোক আগে স্যান্ডেল পরত না, তারা স্যান্ডেল পরছে। এর বেশি কিছু নয়। অর্থাৎ অর্থনৈতিক বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। যেটা ভালো নিদর্শন নয়। উন্নয়নটা সমতাভিত্তিক হচ্ছে না। সমতাভিত্তিক উন্নয়ন না হলে তা টেকসই হয় না। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় আমরা ‘রাজনৈতিক স্বাধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তি’ এ দুটোই চেয়েছিলাম। সেটা পূরণ হচ্ছে কি? এখন আমরা শুধু প্রবৃদ্ধি দেখছি, সুষম বণ্টন দেখছি না।

উন্নয়নকে সুশাসন ও গণতন্ত্র থেকে আলাদা করে দেখা ঠিক নয়। উন্নয়ন ও গণতন্ত্র অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। উদাহরণ দেওয়া হয়, গণতন্ত্র ছাড়াও বিশ্বের কিছু দেশে উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু সে উন্নয়ন টেকসই ও সমতাভিত্তিক নয়। সেখানে শুধু বস্তুনির্ভর প্রবৃদ্ধি ও ভোগবাদের প্রসার হয়েছে। মূল্যবোধ, ব্যক্তিস্বাধীনতা এগুলোর প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ ওই পথে চলুক, আমরা সেটা চাই না।

সৌজন্যে: শেয়ার বিজ