সফল হতে হলে ‘আলাদা’ হতে হবে: ইরতেজা এ খান

Posted on December 26, 2017

মেরিডিয়ান ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট আত্মপ্রকাশ করে ২০১৫ সালে, যা প্রথম বছরেই অর্জন করেছে অভীষ্ট সাফল্য। আধুনিক যুগের ব্যবসা মূলত আইডিয়া নির্ভর। এখানে প্রযুক্তির উৎকর্ষ ও তরুণ জনবলের সর্বোচ্চ বিকাশকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে মেরিডিয়ান। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা জানালেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইরতেজা এ খান।

প্রশ্ন: অতি তরুণ বয়সে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নিজের দক্ষতাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

ইরতেজা এ খান: বয়স অবশ্যই একটা প্রাসঙ্গিক বিষয়। কেননা অভিজ্ঞতার প্রশ্ন এখানে জড়িত। কিন্তু সময় বদলেছে। এখন দেখা যাচ্ছে শুধু আর্থিক খাত নয়, বিশ্বের বড় বড় প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের বয়স ৩০ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে হবে। যে কোনো জায়গায় তরুণরাই জায়গা করে নেবে। তাছাড়া অভিজ্ঞতা সবসময় সময়নির্ভর নয়। পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা ১০ বছরের সমান হতে পারে, যদি কাজের বহুমাত্রিকতা থাকে।

আমার ক্যারিয়ার প্রথম থেকে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক খাতেই গড়ে উঠেছে। ডেলটা ব্র্যাকে প্রায় পাঁচ বছর এবং আইডিএলসিতে ১১ বছর কাজ করেছি। মেরিডিয়ানে ২০১৫তে দায়িত্ব গ্রহণ করি। আমি এ প্রতিষ্ঠানের প্রথম কর্মী। লোক নিয়োগ, প্রক্রিয়া নির্ধারণ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ, শাখার অনুমোদন নেওয়া সবকিছুর দায়িত্ব আমাকে নিতে হয়েছে। অবশ্য পর্ষদ আমাকে সর্বাত্মক সাহায্য করেছে।

আমি ভাগ্যবান যে, আইডিএলসির মতো দেশের সেরা প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। এ প্রতিষ্ঠান আমাকে কাজ করার যথেষ্ট স্বাধীনতা ও ক্ষমতা দিয়েছিল বলেই বহুমাত্রিক দক্ষতা বিকাশের সুযোগ হয়েছে। এ কারণেই মেরিডিয়ানে দুই বছরের মধ্যে আমি যে কাজগুলো করেছি, অনেক নতুন প্রতিষ্ঠানে পাঁচ বছরেও তার বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।

প্রশ্ন: দুবছরে মেরিডিয়ানের অর্জন কতটুকু?

ইরতেজা এ খান: আমাদের বাজারে ঢোকার সময়টা চ্যালেঞ্জিং ছিল। বাজারে অতিরিক্ত তারল্য, বিনিয়োগ স্থবিরতা, ৯টি নতুন ব্যাংককে অনুমোদন দেওয়া নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা। তবে আমি বলব, আমাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়েছে। নতুন একটা প্রতিষ্ঠান শুরুর সময় অনেক নিয়ম ও প্রক্রিয়া ঠিক করা থাকে। এসব চ্যালেঞ্জ সঙ্গে রেখে যে অবস্থায় আসছি, আমরা মনে করি, ভালো করেছি। তবে এর থেকেও বেশি করার আন্তরিক একটা তাগিদ ছিল। ১০ বছর ধরে নয়, আমরা দ্রুত এগোতে চাই। সময়ই সবকিছু, আমরা সময়ের বিরুদ্ধে লড়ছি। তা বলে খারাপ ঋণ করে ফেলব, এ রকম নয়।

মেরিডিয়ানের পোর্টফোলিও সাড়ে ৪০০ কোটি টাকা আর সাড়ে ৩০০ কোটি টাকার আমানত। ২০১৬তে আমাদের মুনাফা ছিল পাঁচ কোটি। শূন্য ভাগ শ্রেণিকৃত ঋণ। আমি মনে করি, প্রথম বছর মুনাফা করাও বড় একটা অর্জন। এর মধ্যে তিনটি শাখা খোলা হয়েছে। দুটি সিন্ডিকেশন চুক্তি চূড়ান্ত করেছি। আমাদের কর্মীরা খুব ভালো প্রতিষ্ঠান থেকে এসেছে। এটাও একটা বড় অর্জন। নতুন প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের আকর্ষণ করা কঠিন বিষয়। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের রিফাইন্যান্সিং স্কিম নারী উদ্যোক্তা, এসএমই, সাসটেইনেবল বা গ্রিন ফাইন্যান্স সবগুলো আমাদের যোগ্যতা অনুযায়ী অর্জন করতে পেরেছি। ‘কোর ফাইন্যান্সিয়াল সলিউশন’ আমরা নিতে পেরেছি। ফলে মেরিডিয়ানের সব কার্যক্রম প্রযুক্তির আওতায় আসবে। পাঁচ-দশটি এনবিএফআই ছাড়া বেশিরভাগেরই এ সফটওয়্যার নেই। আশা করছি, ২০১৭তে আমাদের মুনাফা গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ হবে। সুতরাং কাছাকাছি এনবিএফআইয়ের তুলনায় আমরা ভালো করছি।

প্রশ্ন: নতুন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রাহক আকর্ষণ করতে কী ধরনের বিপণন কৌশল অনুসরণ করছেন এখন?

ইরতেজা এ খান: আমি দৃঢ়ভাবে মনে করি, সফল হতে হলে ‘আলাদা’ হতে হবে। এটা আমাদের সেøাগান বলতে পারেন। বিপণন কৌশল অনেক বড় ব্যাপার। সমন্বয়ের ব্যাপার আছে। অনেক ধরনের বিপণন কৌশল আছে, যা এখনও কেউ অনুসরণ করেনি। এ মুহূর্তে নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হয় আমরা কোথায় ব্যবসা করব, কে আমার গ্রাহক। নির্দিষ্ট গ্রাহকের কাছে পৌঁছানোই লক্ষ্য, যাকে বলে ‘ডাইরেক্ট মার্কেটিং’। সুতরাং এ মুহূর্তে বিজ্ঞাপনের পথ বেছে নিচ্ছি না। আসলে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে গ্রাহক ডেকে আনব, এখনও সেই সময় আসেনি। ধরুন মেরিডিয়ানের পোর্টফোলিও ও আমানত অনুযায়ী বড় বিজ্ঞাপন দিয়ে অনেক গ্রাহককে যদি আনি, আমি কিন্তু সেবা দিতে পারব না। সুতরাং এখন আমরা ‘ডোর টু ডোর’ বিপনন কৌশলের ওপর নির্ভরশীল। আর আমাদের প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাই এটা করছে।

প্রশ্ন: মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নে মেরিডিয়ানের ভাবনাটা ঠিক কেমন?

ইরতেজা এ খান: নতুন প্রজন্ম ‘আইডিয়া’ দিয়ে পূর্ণ। এটাই হচ্ছে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে কাজ করার সৌন্দর্য। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ‘আইডিয়া’ কীভাবে রোপিত হয়? আমরা কর্মীদের যথেষ্ট পরিমাণে ক্ষমতা দিই, যাকে বলে ‘ইমপাওয়ার’ করা। সব সিদ্ধান্ত কি সিইও নেবে! মাঠে কাজ করার অভিজ্ঞতা কি সিইওর থাকে? সুতরাং একজন কর্মীর সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা থাকা জরুরি। আর এমন পরিবেশ তৈরি করলে নতুন নতুন আইডিয়া পাওয়া সম্ভব। মেরিডিয়ানের কর্মীদের বলা হয়েছে, আপনি কখনোই আইডিয়া দেওয়া থামাবেন না। ভালোমন্দের বিচার ঊর্ধ্বতনরা করবেন। হতেই পারে তাদের কোনো আইডিয়া মহামূল্যবান।

প্রশ্ন: মেরিডিয়ানের ট্যাগ লাইন হচ্ছে ‘সেপিং স্টোরিজ’। বিষয়টি ব্যাখ্যা করবেন?

ইরতেজা এ খান: আমরা সফলতার সঙ্গে নয়, বরং একজন উদ্যোক্তার চলার অমসৃণ পথের গল্পের সঙ্গে থাকতে চাই। আজকের যে কোনো বড় উদ্যোক্তাই ছোট অবস্থা থেকে শুরু করেছে। বাধা-বিপত্তি সয়ে এসেছে। বিশ বা তিরিশ বছর আগের উদ্যোক্তার বেশিরভাগ গল্পই আজও বিদ্যমান। ৯৯ ভাগ ক্ষেত্রে উদ্যোক্তার সবচেয়ে বড় সমস্যা ইকুইয়িটি সংকট। সুতরাং তার একটা সঠিক আর্থিক পার্টনার লাগবে যে, এই সংকটের ভাগিদার হতে। নতুন উদ্যোক্তাদের বেশিরভাগই শুরুতেই ব্যাংক থেকে ঋণ পায় না। এসব ক্ষেত্রে বিশেষ পর্যবেক্ষণের মধ্যে রেখে আমরা তাদের ব্যবসা প্রসারের অংশীদার হই। ব্যবসা উন্নয়নের তথ্য ও পরামর্শ দিয়েও আমরা সহযোগিতা করি। যেসব উদ্যোক্তা ছোট পরিসরে প্রথম থেকে ব্যবসা শুরু করেছেÑতারা যে মন্দ ঋণ করেছে, পরিসংখ্যান তা বলে না।

প্রশ্ন: শেয়ার বিজের মধ্য দিয়ে মুক্তভাবে কিছু বলতে চান কি?

ইরতেজা এ খান: তরুণ সিইও হিসেবে আমি মনে করি, বাংলাদেশের সম্ভাবনা অপরিসীম। আর্থিক খাতে কাজ করার সুবাদে অনেক উন্নয়ন কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। দেশের প্রবৃদ্ধির ধারা ছয় শতাংশের ওপর। এটা সমন্বিত প্রচেষ্টার ফল। অবকাঠামো খাতে এমন কিছু বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প হচ্ছে, যা আগে কল্পনা করিনি। এখনকার প্রবৃদ্ধি হিসাব করা হচ্ছে বিগত উপাত্তের ওপর। কিন্তু আরও পরে তাকালে দেখা যাবে শুধু পদ্মা ব্রিজই হয়তো অবদান রাখবে এক ভাগ প্রবৃদ্ধি। মেট্রোরেল অবদান রাখবে। বাংলাদেশ যে মধ্যম আয়ের দেশ হতে যাচ্ছে এটি রসিকতা নয়। বরং বাস্তবতা। সুতরাং যে যেখানে আছি সবার ভিশন থাকতে হবে, আমরা এ উন্নয়নের অংশ হবো। সার্বিক অর্থনীতি বড় হলে লোকজনের ক্রয়ক্ষমতা ও জীবনযাত্রার মান বাড়বে।

দ্বিতীয়ত: আমরা যারা আর্থিক খাতে কাজ করছি, আমাদের দায়িত্ব আরও বেশি। আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠাকে জরুরি ভিত্তিতে দেখতে হবে। এ জায়গাগুলোতে আপস করলে বিনিয়োগগুলো সম্ভবত আমরা পাব না। এই যে অবকাঠামোর উন্নয়ন ঘটছে, সব টাকা তো আমাদের নয়। বিভিন্ন দেশ বিনিয়োগ করছে। ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল আসতে যাচ্ছে। অবকাঠামো ভালো হলে বাইরের বিনিয়োগকারীরা ছুটে আসবে। কারণ সস্তা শ্রমমূল্যে এত তরুণ জনগোষ্ঠী পাওয়ার সুযোগ খুব কম দেশেই আছে।

এখন পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অনেক বেশি ঢুকতে দেখা যাচ্ছে। কেন ঢুকছে? সম্ভাবনা দেখছেন তারা। ইদানীং নিয়ন্ত্রক সংস্থা পুঁজিবাজার সংস্কারের অনেক উদ্যোগ নিয়েছে। বাজার এখন অনেক সুসংবদ্ধ। বিনিয়োগকারীরা এখন অনেক বেশি যুক্তিনির্ভর বিশ্লেষণের ওপর নির্ভর করছে। এসব আশার কথা।রাজনীতিও একটা ইস্যু। এখানে মতবিরোধ থাকবেই। কিন্তু দেশের সার্বিক উন্নয়নই সবার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।

সৌজন্যে: শেয়ার বিজ