কবি মাহাবুবা লাকির তিনটি কবিতা

Posted on February 9, 2023

কবিতা -১

নিঃসঙ্গ খোলা জানালা

কত বসন্ত গত হয়েছে-----
পোয়াতি মেঘের দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে,
আহত বেদনায় দু'চোখ ভিজেছে কখনো-সখনো
চাওয়া না পাওয়ার অপূর্ণতার হিসেবে।
এই রঙমহল,এই চৈতালী জলসা
ওই তারা ঝিলমিল রাতের আকাশ,
যেদিকে তাকাই সেখানে শুধু একটি
প্রিয়মুখের কথাই ভেবেছি----
আর ভেবেছি নীলকষ্টে মোড়া ওই আকাশকে।
তাহলে আকাশই কি আমার শেষ ঠিকানা?
তবে যত দূরেই যাও
!জেনে রেখো প্রিয় রাত্রির ঘরে
আমারও একটি নিঃসঙ্গ খোলা জানালা আছে।
জীবনের কাছে যারা রাতজাগা অমাবস্যার পাখি
তারা ওই জানালার কাছে এসে করুণ কান্নায়
আমাকে তাদের হেরে যাওয়ার গল্প শোনায়।
আর আমি রক্তাক্ত স্রোতের উপর দগদগে ঘা নিয়ে
নীরবে তাদের কথা শুনি ছলনার হাসি মুখে এনে।
আমা থেকে যত দূরেই থাক না কেন;
যত শব্দহীন পায়ে হাঁটো না কেন তুমি
আমি বুঝতে পারি অনন্ত সেই অভিসারের কাহিনী।
সেই নিভৃত চরণের শব্দের কাছে আমি বারবার নত হই
এবং ফিরে আসার নিষ্ফলা ইচ্ছের জন্য অপেক্ষা করি,
এই বিভোরতা, এত বসন্তের চব্বিশ পরগণা
অন্তহীন দেহের ভাঁজে ভাঁজে শুধু লালন করি,
সাদাকালো চশমায় চোখের ইংগিতে স্বপ্ন বুনে।
একদিন পূর্ণিমা এনে দেবে বলে -সেই যে
জোসনার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেলে,
আর দেখা হলো না, ফিরে ও এলে না কোনদিন।
তবে তোমার কথার সৌরভ নিরাভরণ পাঁজরে মাখি
যেনে রেখো এই নির্বাসন-এই একাকিত্ব
এই আঁধার রাতের প্রহর গুনে গুনে
এখনো চলমান-আজো বেঁচে আছি-ভাল আছি বেস।

কবিতা -২
কানা দর্শক

কিছু দেখছি না কিছু বলছি না
তবুও শ্রোতা
ঘটছে হরদম ঘঠন-অঘঠন
ঘটে যাচ্ছে একের পর এক
তবুও কানা দর্শক।

যতটুকু বলছি-তা প্রসঙ্গ
যা বলছি না -তা আলাপ
এমন একটি গল্পের এনভেলপ
আমি দিব্বি বয়ে বেড়াচ্ছি।

তবে ছলোনার অধিক হাসি দিয়ে আঁকা
প্রেম ও ঘৃণার ন্যায় সমোঝোতাহীন
পৃথিবীটা ঘুরছে মাথার ভেতর।
কি করা উচিৎ-কি করা অনুচিত
ভেবে পায় না বিবেকের চৌকাঠ।

চৈতালি প্রহর পাঁজর ভাঙছে ক্রোধে
প্রতিবাদে তপ্ত হচ্ছে বারংবার ওষ্ঠ,
তারপর ও বিস্মৃতি কিম্বা উড়োচিঠির হাত হয়ে আসা
প্রতিদিনকার সংবাদ নিত্তির ওজনে;
পড়ি-ছিড়ি আর উড়িয়ে দেই দূর্লভ হাওয়ায়।

তবুও পিছু ছাড়েনা খুঁনসুটি ছলনাময়ী ঝড়
কোথাও সামান্য কোন প্রসঙ্গকথা বলতেই,
একটা আলাপের হাত থেকে
আর একটা আলাপের মুখে বসে গল্পটা
রেললাইনের মতো আরো বেশি দীর্ঘ হতে থাকে।
সরুপাতের উপর পাত উঠিয়েও থামানো যায় না
এসব টালমাটাল চরিত্রগুলোকে।

কবিতা -৩
হারিয়ে গেছি সোনার মোহরের মতো

সম্পর্কের সিঁড়িবেয়ে ঊর্ধ্বে ওঠার কোন গতিপথ
আজ আর আমার চোখের সীমানায় নেই,
বিশ্রী অজানা লোভে উড়ে গেছে বন্ধনের সব সুখপাখি।
বিষন্ন দুপুরের সেই চঞ্চলতাকে ঘৃণা করে একেবারেই
আহত বেদনায় রেখে গেছে শুধু নিস্তেজ দুটি ডানা।

চারিদিকে শুধু ক্লান্তরেখা, সবখানে বিষন্ন বিভ্রাট
সম্পর্কের উঠোনে সাজানো বেগুনি আকাশ নিয়ে
এ কোন হোলি, লোভ ও স্বার্থের তালবাহানা?
আনন্দ ও খুশির তিলোত্তমা হাওড়ের দিকে
কেন ধেয়ে আসছে অশনি বিদ্যুৎ প্রবাহের নির্লজ্জ খেলা।

অভিলাষী পিপড়া বিষাক্ত পিঁড়ি পেতে বসে আছে
আর কেন ভেঙে যাচ্ছে দূরগামী সাজানো বিকেলটা।
যেন জরা থেকে উড়ে গেছে সুখ ও স্নেহের পাখি
কতশত -তেরশত পঁয়ষট্টি দিনের তালকানা বিচে
হারিয়ে গেছে বিশ্বাস ও সরলতা হারানো সেই বালিকা!

হয়তো দ্বিধাগ্রস্ত শামুকের স্নানদৃশ্য দেখে ভয়ে
পালিয়ে গেছে সব বিরোধের কুহুকের ঝামেলা,
যাচ্ছে তাই অবজ্ঞা আর ফালতু সময় ভেবে।
কয়েকবার জানতে ইচ্ছে করছে!
হে বারমাসি ফল রবিফুলের রঙ ধারন করে
আর কতকাল কদিন এভাবে ডালে ঝুলবে?

হুশ ফিরে এলে নিজেকেই ধিক্কার দেই ধূর!
বিতস্ত্র এই পবিত্র মনে কিসের এতো সময় নষ্ট করছি।
যেসকল আস্থার মাটি খুঁজে হাজার কাজের ভীড়ে
মনটাকে ফেলে রাখতাম আনন্দের সিজদায়,
বেলাশেষে দেখি সেই জীবনের খেলাঘর থেকে
চিরতরে হারিয়ে গেছি সোনার মোহরের মতো
খুব সহজেই দারুন অবলীলায় সময়ের খাদে।