অনিয়মে ডুবছে এ্যাপোলো ইস্পাত, নিরব নিয়ন্ত্রক সংস্থা

Posted on January 4, 2022

আরিফ হাসান: দেশের প্রধান শেয়ার বাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এ তালিকাভুক্ত প্রকৌশল খাতের অন্তর্ভূক্ত এ্যাপোলো ইস্পাত লিমিটেড। পুঁজিবাজারে অনিয়মই যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে কোম্পানিটির। কোন প্রকার কর্পোরেট গভর্ন্যান্স কোড না মেনেই বাজারে লেনদেন চলমান রেখেছে কোম্পানিটি।বার বার এ বিষয়ে সংবাদ প্রচারের পরেও কোন প্রকার পদক্ষেপ নেয়নি নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো।

১৯৬০ সালে ট্রেডিং ব্যবসার মাধ্যমে ক্যারিয়ার শুরু করেন সদ্যপ্রয়াত শিল্পপতি দীন মোহাম্মদ। ফিনিক্স গ্রুপ ও এ্যাপোলো গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের অধীনে ডজন খানেক শিল্প ও সেবাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এই শিল্পপতি । তার গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পাঁচটি বর্তমানে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত রয়েছে।

এর মধ্যে এ্যাপোলো ইস্পাত কমপ্লেক্স লিমিটেডের ব্যবসায়িক ও আর্থিক অবস্থা বেশ কয়েক বছর ধরেই নাজুক অবস্থানে রয়েছে। ঋণের দায়ে প্রতিষ্ঠানটির অবস্থা মৃতপ্রায়। এ অবস্থায় দীন মোহাম্মদের প্রয়াণের পর তার উত্তরাধিকারীরা দেনা থেকে মুক্তি পেতে প্রয়োজনে কোম্পানিটি বিক্রি করে দেয়ার কথাও ভাবছেন বলে জানা গেছে।

জানা গেছে বর্তমানে এ্যাপোলো ইস্পাতের বিভিন্ন খাতে মোট ঋণের পরিমান দাঁড়িয়েছে ৮৪৫ কোটি টাকা। তার মধ্যে ব্যাংক ঋন দাঁড়িয়েছে ৫৫০ কোটি টাকায়। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে ঋণ রয়েছে ২৪০ কোটি টাকা। এছাড়া পার্টিদের কাছে ঋণ রয়েছে ৫৫ কোটি টাকা। কিন্তু এই ঋণ পরিশোধ করতে ব্যার্থ এ্যাপোলো ইস্পাত কমপ্লেক্স লিমিটেড। পাওনাদারদের পাওনা পরিশোধেরও কোনো উদ্যোগ নেই। দিচ্ছি, দেব বলেই পার করছেন বছরের পর বছর। ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা পথে বসেছেন।

কোম্পানিটির বিভিন্ন কর্মকর্তার ভাষ্যমতে, ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শোয়েবের অদক্ষতা, যোগ্যদের অপসারণ করে অদক্ষ লোক নিয়োগের কারণে ডুবেছে কোম্পানিটি। নানা কাজে কোম্পানিতে অযাচিত হস্তক্ষেপ করেন ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শোয়েব। তারা আরোও বলেন, ব্যাংকঋণ পরিশোধের কোনো চিন্তা নেই তার এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাত-আট মাস ধরে কোন প্রকার বেতন না দিয়ে তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন শোয়েব। এর আগে কোম্পানিটির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) রাজিব হোসেনের বিরুদ্ধে ৯ কোটি টাকার বেশি অর্থ আত্নসাতের মামলায় তাকে জেলে পাঠানো হয়।

এদিকে কোন প্রকার কর্পোরেট গভর্ন্যান্স কোড না মেনেই বাজারে লেনদেন চলমান রেখেছে কোম্পানিটি। এমনকি কয়েক বছর ধরেও কোন প্রকার আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছেনা এ্যাপোলো ইস্পাত।

আইনি বাধ্যবাধকতা থাকলেও প্রতিষ্ঠানটির নেই কোন কোম্পানি সেক্রেটারি, নেই কোন অফিসিয়াল ওয়েবসাইট। যদিও শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে কারখানায় উৎপাদন বন্ধ কিংবা চালুর বিষয়টি অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ মূল্যসংবেদনশীল তথ্য। সিকিউরিটিজ আইন অনুসারে এ ধরনের তথ্য স্টক এক্সচেঞ্জ ও শেয়ারহোল্ডার দের জানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অথচ এ্যাপোলো ইস্পাত আইপিওর অর্থে বাস্তবায়িত এনওএফ প্রকল্পে উৎপাদন শুরুর বিষয়ে ডিসক্লোজার দিলেও বন্ধের বিষয়ে তথ্য প্রকাশ না করায় কয়েক বছর ধরে কোম্পানির প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অন্ধকারে রয়েছেন শেয়ারহোল্ডাররা ।

অ্যাপোলো ইস্পাতের এসব খামখেয়ালিপনা, আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন এবং শেয়ার বাজার থেকে প্রতিনিয়ত টাকা তুলে নেওয়ার বিষয়গুলো রেগুলেটরি সংস্থাগুলো দেখেও কোন পদক্ষেপ নিচ্ছেনা।

এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও কোম্পানি বিশেষজ্ঞ মোঃ মিজানুর রহমান, এফসিএস কর্পোরেট সংবাদকে বলেন, “ধারাবাহিক বিপর্যয় ও দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা-সমালোচনায় থাকলেও এ্যাপোলো ইস্পাতের বিষয়ে বিএসইসির নিরব ভূমিকা রহস্যজনক”।

তিনি আরও বলেন, “এ হেন কারনে পুঁজিবাজারের একাধিক কোম্পানি সাধারন শেয়ার হোল্ডারদের প্রতারনা করে কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। নিজেদের দুর্ণীতির দায় চাপিয়ে দিচ্ছে সাধারন শেয়ার হোল্ডারদের ঘাড়ে। দ্রুত এ্যাপোলো ইস্পাত সহ সকল দেউলিয়া কোম্পানি গুলোকে বিএসইসির তথ্যাবধানে একটি সমাধানের পথ নিশ্চিত অথবা ডিলিস্ট করার পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথ্যায় এ সকল কোম্পানি গুলো বর্তমান পুঁজিবাজারের অর্জিত সাফল্যকে ম্লান করে দিয়ে পুঁজিবাজার তথা দেশের অর্থনীতিতে বিশাল ক্ষতির কারন হয়ে দাঁড়াবে”।

কোম্পানিটির মোট শেয়ার ৪০ কোটি ১৩ লাখ ৮ হাজার ৬০০ টি। তার মধ্যে ২০.২৪ শতাংশ উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারি ২০.৫৩ শতাংশ, বিদেশি বিনিয়োগকারি ০.৪২ শতাংশ এবং বাকি ৫৮.৮১ শতাংশ শেয়ার সাধারন বিনিয়োগ কারিদের হাতে।

কোম্পানিটি বিগত ৪ বছর ধরে এজিএম করেনি, দেয়নি কোন লভ্যাংশ। কোম্পানিটি বিগত ৫ বছরে লভ্যাংশ দিয়েছে যথাক্রমে ২০১৮ সালে ৩ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড, ২০১৭ সালে ১০ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড, ২০১৬ সালে ৫ শতাংশ স্টক ও ১০ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড, ২০১৫ সালে ১২ শতাংশ স্টক ও ৩ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড এবং ২০১৪ সালে ১৫ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড।
কোম্পানিটির অনুমোদিত মুলধন ৫০০ কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মুলধনের পরিমান ৪০১ কোটি ৩০ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা।
কোম্পানিটির অভিহিত শেয়ারের মূল্য ১০ টাকা। গত এক বছরে কোম্পানিটির শেয়ার দর ওঠানামা করে সর্বনিম্ন ৫.১০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ১৪.৮০ টাকা। ২০১৩ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়ে বর্তমানে কোম্পানিটি মার্কেটের বি ক্যাটাগরিতে অবস্থান করছে।