বদরুল ইসলাম বাদল : দেশে একসময় যৌথ পরিবারের বহুল প্রচলন ছিল। এখন সে ধারাটি অতি নগন্য। ছিন্ন বিছিন্ন এই সকল পরিবারের সবচেয়ে নিগ্রহের শিকার বয়োবৃদ্ধ মা -বাবা। একা নিঃস্ব অসহায় হয়ে যায় তারা।বহু কষ্টে বড় করা সন্তানের ঘরে ঠাই হয় না মায়ের।খেতে পায় না।চিকিৎসা পায় না। কান পাতলেই এসব মায়েদের কান্নার আওয়াজ শোনা যাবে অহরহ। প্রতিদিন খবরের কাগজে উঠে আসে এমন সংবাদ, তবে তার চেয়েও বেশী পর্দার আড়ালে পড়ে থাকে। রাস্তাঘাটে ময়লা কাপড়ে ভিক্ষার ঝুলি হাতে দেখতে পাওয়া যায় অনেক বয়স্ক মহিলা, তিনি হয়তোবা কারও মা।দরদ দিয়ে কথা বললে উঠে আসে তাদের জীবনের ছন্দ পতনের কাহিনী। বয়সের ভারে কম্পিত হাতে ভিক্ষা করা মা টিও বলতে চায় না সন্তানদের দ্বারা অবজ্ঞার কথা, দায়িত্বহীনতার কাহিনী। অথচ দুমোড়ো ভাতের ক্ষুধায় মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে ফিরে। তিনিই সে মা, যিনি সুখেদুখে সংসার আগলিয়ে রাখেন। সেসব অসহায় মায়েদের সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে আসেন "মা ফাউন্ডেশন"চকরিয়া, কক্সবাজার।
আনম রুস্তম আলীর প্রতিষ্ঠিত এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে প্রতিমাসে এক/দুই জন অসহায় মাকে সহযোগিতা করা হচ্ছে। আর মায়েদের প্রতি ভালবাসার সচেতনতা সৃষ্টির জন্য চার বছর যাবত "মা কুইজ" প্রতিযোগিতার আয়োজন করে আসছে। এই কুইজ ইতিমধ্যে ছাত্রছাত্রীদের মাঝে ব্যাপক ছাড়া জাগিয়েছে। আর্থিক সহযোগিতা এবং কুইজ প্রতিযোগিতা সহ বিভিন্ন প্রচার কর্মসূচি বাস্তবায়নে 'মা ফাউন্ডেশনের' সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি নিয়ে প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই। মাত্র ৬ জন সদস্য নিয়ে যাত্রা মা ফাউন্ডেশনের,যার বর্তমানে ২০০ জন সদস্য। আরো বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের অংশ গ্রহণ এই প্রতিষ্ঠান অনেক মায়ের সেবা করা সুযোগ পাবে এবং সামাজিক সচেতনতা তৈরিতে সহায়ক হবে। অসহায় মা'য়েদের পাশে দাড়ানো সামাজিক দায়বদ্ধতারই কর্মসূচি।
বয়স্ক পিতামাতার দেখভাল না করিলে এক লক্ষ টাকা জরিমানা বা তিন মাসের কারাদণ্ডের বিধান নিয়ে আইন রয়েছে আমাদের দেশে। ভারতীয় আইনে ও সরকারি চাকরিতে যারা আছেন তাদের চাকরির শর্তে মা বাবার দায়িত্ব বাধ্যতা আছে। নেপালে সরকারি কর্মচারীদের বেতন থেকে সরাসরি পিতামাতার খরচের টাকা তাদের একাউন্টে জমা করার কথা বলা হয়েছে। তবে মা বাবার ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়ে আইন যাহাই থাকুক না কেন বিষয়টি সভ্যতার জন্য কলংকজনক। কারণ সন্তান মানুষ করার বেলায় আইনি বাধ্যবাধকতার চিন্তা আসে না মায়ের মনে।মায়েরা নিজের দায়িত্ববোধ থেকে সন্তানদের আগলাইয়া রেখে বড় করে।সন্তানদের মানুষ করতে জীবনের সর্বস্ব ব্যয় করে থাকেন। রাতের পর রাত জেগে থেকে খেয়ে না খেয়ে লালনপালন করে।সন্তানের সুরক্ষা এবং মঙ্গল কামনায় সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা রত থাকে সবসময়ই। অথচ জীবনের বেলাশেষে সে সন্তানের ঘরে জায়গা হয় না মা- বাবার। বর্তমান সময়টাতে পৃথিবীর মাঝে বড়ো নিষ্ঠুরতম মানুষের বসবাস। বৃদ্ধ বয়সে একাকিত্ব নিয়ে কত যে অসহায় হয়ে যায়, যা সত্যিই অমানবিক। ছেলে বড় কর্মকর্তা আর মা ভিক্ষার থলে নিয়ে রাস্তায় কুঁড়েঘরে। রোগাক্রান্ত মায়ের খবর নেবার প্রয়োজনবোধ করে না অনেকে। তবে সামাজিক বিশ্লেষকদের মতে আইন করে এসব সামাজিক সমস্যা দূর করা সম্ভব হবার নয়।দরকার সামাজিক সচেতনতা। বাঙালী সংস্কৃতিতে ঐক্যবদ্ধভাবে বসবাস করা দীর্ঘদিনের সামাজিক বৈশিষ্ট্য।একই সমাজে বসবাসের কারণে মানুষের উপর সামাজিক রীতিনীতি প্রকটভাবে প্রভাব ফেলে। রেওয়াজ ছিল যে, একান্নবর্তী পরিবারে কোথাও মা বাবাকে অবহেলা করলে সমাজের মানুষ তাদের ঘৃণা করতো। তাই চক্ষু লজ্জার ভয়ে অবহেলা করার সাহস পেতেন না সন্তানেরা। ইতিহাস সাক্ষী আগেকার সময়ে সমাজ এবং পঞ্চায়েতে এসব সমস্যার বাস্তবমুখী সমাধান করা হতো। এমনকি যে ছেলে মা'কে অবহেলা করতো, খাবার দিতে গড়িমসি করতো সেসব সন্তানের পেটে ইট বেধে ঘুরানো হতো।মাকে অবহেলা করার কথা প্রকাশ হয়ে গেলে প্রতিবেশী ঘৃণার চোখে দেখত তাদের।
আত্নীয়তা করতে চাইতো না। আধুনিকতার ছোঁয়ায় সেসব রীতিনীতি বিলুপ্ত প্রায় এখন ।তাই প্রতিকারের জন্য আইনের উপর নির্ভরশীল হতে হয়। তবে নিশ্চিত ভাবে বলা যেতে পারে, মা-বাবার পরিচর্যা নিয়ে যতদিন সামাজিক সচেতনতা ফিরিয়ে না আসবে ততদিন নিস্তার পাওয়া যাবে না বলে মনে করে বিশেষজ্ঞ মহল। গত কিছু আগে একটি লেখায় উল্লেখ করেছিলাম যে,,আমাদের সমাজে যে কোন ধরনের নির্বাচনে জনসম্পৃক্ততা থাকে প্রচুর। নির্বাচনে প্রার্থীর ইস্তেহার প্রকাশ করে থাকে। ইস্তেহারে উল্লেখ করা যেতে পারে "যারা মাকে ভালবাসে না তাদের ভোটের দরকার নাই। আর নির্বাচিত হলে মায়ের সাথে যারা অন্যায় করে তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে"। ফলে প্রত্যেকটি পরিবারের মানুষের কাছে সংবাদটি পৌঁছে যাবে।সতর্ক হবে মানুষ।
এই পর্যায়ে জনপ্রিয় গায়ক নকুলচন্দ্র বিশ্বাসের এই গানটি খুবই জনপ্রিয়তা পায়,, " যারা মাকে ভালবাস না,তারা আমার গান শুনিস না"। শিল্পীর যেকোন অনুষ্ঠানে গানটির অনুরোধ থাকে সবচেয়ে বেশি। সন্তানের জন্য মা যা করতে পারে দুনিয়ায় আর কেউ পারে না। পৃথিবীতে যার নজির ভুরি ভুরি। বিগত কাতার বিশ্বকাপ ফুটবলের সবচেয়ে আলোচিত ছবির একটি মরক্কোর তারকা ফুটবলার আশরাফ হাকিমি এবং তার মায়ের সাথে আদর বিনিময়ের ছবি। গোল করার পর আশরাফ হাকিমি ছুটে যায় গ্যালারীর সে কোণে, যেখানে তার মা বসে আছেন।আশরাফ হাকিমির বাবার সাথে তার মায়ের ছাড়াছাড়ির পর অতি কষ্টে বড়ো করেছেন তাকে। পরের বাড়িতে কাজ করে ছেলেকে মানুষ করেছেন, প্রতিষ্ঠিত করেছেন।আজ তিনি বিশ্বে আলোচিত ফুটবল তারকা। যা অবলীলায় খেলার মাঠে মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা ভরে প্রকাশ করেন আশরাফ হাকিমি নিজে। মুক্তিযুদ্ধকালীন একজন মুক্তিযোদ্ধার মায়ের বাস্তব কাহিনী তুলে ধরার চেষ্টা করছি। বিখ্যাত লেখক আনিসুল হকের " মা" গ্রন্থে কাহিনী টি স্হান পেয়েছে।১৯৭১ সালে আযাদ নামে একজন ছাত্র যুদ্ধে গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে।তাকে থানায় নিয়ে রাখে পাকবাহিনী এবং নির্যাতন করতে থাকে।
আটকের কয়েক দিন পর আযাদের মা ছেলেকে থানায় দেখতে গেলে আযাদ মাকে বলে, "মা কতদিন ভাত খাইনি, আমার জন্য ভাত এনো তো। খুব ভাত খেতে ইচ্ছে করে"। মা পরের দিন ভাত রান্না করে ছেলের জন্য থানায় নিয়ে যায়।কিন্তু ছেলে আর নাই। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আযাদকে মেরে লাশ গুম করে ফেলে।ফলে মা ছেলেকে ভাত খাওয়াতে পারে না।এই ঘটনার পর মা জীবিত ছিলেন চৌদ্দ বছর। এই চৌদ্দ বছরে মা কখনো ভাত স্পর্শ করে নাই। ছেলেকে ভাত খাওয়াতে পারে নাই বলে মা আর কোনদিন ভাত খায় নাই। রুটি খেয়ে দিনাতিপাত করেছে চৌদ্দটি বছর। ছেলেকে থানায় বিছানা ছাড়া ঘুমাতে দেখেছিলেন তিনি, তাই আর কোন দিন বিছানায় ঘুমায় নাই শহীদ আযাদের মা। এমনই হয়ে থাকে মা। এমন হাজার হাজার সত্য কাহিনী রয়েছে।এমন মায়েদের কান্নায় ভারী হয়ে আসছে পৃথিবীর আলো বাতাস।
আল্লাহ তালা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন, "তোমরা আমার শোকর করো এবং সঙ্গে সঙ্গে মা বাবার ও"।(সুরা লোকমান ১৪)।বুখারী হাদিসের বর্ণনা মতে, প্রতিবার সন্তানের মায়ের দিকে যত্নের দৃষ্টিতে তাকানোর জন্য একটি কবুল হজ্জের সওয়াব লিখে দেওয়া হয়। মায়ের সাথে অসম্মানজনক আচরণ ইসলামে কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে।রাসুল (সাঃ))বলেন, 'আল্লাহ তাআলা মায়ের অবাধ্য হওয়াকে তোমাদের জন্য হারাম করে দিয়েছেন। '(মুসলিম ;৪৫৮০)।.তিনি বলেন," তিন রকম মানুষের দোয়া নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট সরাসরি কবুল হয়, মজলুমের দোয়া, মুসাফিরের দোয়া আর সন্তানের জন্য পিতামাতার দোয়া। (তিরমিজি।) বায়েজিদ বোস্তামী সকলের পরিচিত একজন আওলিয়া। শৈশবে একদিন রাতে পড়াশোনা করছিলেন তিনি , শীতের রাত।মা ঘুমে আছেন। গভীর রাতে মা তাকে বলল "এক গ্লাস পানি দাও বাবা"। বায়েজিদ বোস্তামী পানি আনতে গেলে দেখে ঘরে পানি নাই। তাই কূপ থেকে পানি তুলে নিয়ে আসতে আসতে মা আবার ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম ভেঙে গেলে মায়ের কষ্ট হবে, তাই তিনি মাকে না ডেকে সারারাত পানির গ্লাস হাতে মায়ের শিয়রে দাড়িয়ে রয়েছিলেন। ফজরের সময় মায়ের ঘুম ভাঙলে সবকিছু জানতে পেরে ছেলের মাতৃভক্তি দেখে মায়ের মন আনন্দে গর্বে ফুলে উঠে। তখন মা দুহাত তুলে দোয়া করলেন, "হে আল্লাহ আমার বায়েজিদকে সুলতানুল আরেফিন হিসেবে তোমার বন্ধুর দপ্তরে অতি মর্যাদার আসন দান কর"। পরবর্তী সময়ে তিনিই আওলিয়া বায়েজিদ বোস্তামী (রাঃ) হিসেবে পরিচিতি পায়। বাংলাসাহিত্যের অন্যতম পন্ডিত ইশ্চরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একদিন মায়ের ডাকে ওয়াদা রক্ষায় বাড়ি যাচ্ছেন। দূর্যোগেপুর্ণ রাত ছিল। নদী পার হয়ে ওপারে যাবার খেয়া পারাপার বন্ধ হয়ে যায়। তখন তিনি মা ভৈ' বলে সাতঁরিয়ে নদী পার হয়ে বাড়ি পৌঁছে বলে, মা আমি এসে গেছি।'' মা' তাকে দুহাত 'ভরে আর্শীবাদ করে। তিনিই পরবর্তী সময়ে বিদ্যাসাগর হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন।
এই পর্যন্ত মা ফাউন্ডেশন ২৫০০ জন মায়ের পাশে আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছেন। ৫০ কেজি চাউল,১০ কেজি আলু,তিন কেজি করে পিয়াজ,তেল ডাল,লবণ,আটা এবং সাবান দেয়া হয়। "আর্ত মানবতার সেবায়" প্রতিপাদ্য নিয়ে এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা এবং পরিচালক আনম রুস্তম আলী বলেন, "আপনার আশেপাশে এরকম কোন অসহায় নিঃস্ব মা,যিনি অসুখে খানাপিনায় কষ্ট পাচ্ছে' থাকলে আমাদের জানান,আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করবো কিছু সাহায্য করার।" সাধারণ সম্পাদক মোঃ শফিউল আলম সহ ২১ সদস্য বিশিষ্ট কার্যকরী কমিটি নিয়ে "মা ফাউন্ডেশন পরিচালিত হচ্ছে।
লেখক: কলামিস্ট ও সমাজকর্মী সদস্য, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন কেন্দ্রীয় কমিটি।
© ২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | কর্পোরেট সংবাদ সম্পাদক - মোঃ মিজানুর রহমান । উপদেষ্টা সম্পাদক- জেসমিন আক্তার, এফসিএস ই-মেইলঃ corporatesangbad@gmail.com । ফোনঃ ০২২২-৩৩৫৪১২৫ । মোবাইলঃ ০১৭১১০৭৬৮১৫ অফিসঃ ৫৫/বি, নোয়াখালী টাওয়ার, ১১ তলা, সুইট ১১-এফ, পুরানা পল্টন, ঢাকা ১০০০ |
মা'ই শক্তি, ভক্তিতে মুক্তি এবং মা ফাউন্ডেশন https://corporatesangbad.com/11241/ |