প্রত্যাশিত ও অপ্রত্যাশিত বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে শেষ হলো আরো একটি বছর ২০১৬। সেই সাথে শুরু হল নতুন একটি বছর ২০১৭। প্রতিবারের মত এবারেও নতুন বছরকে ঘিরে সবারই মনে নতুন প্রত্যাশা কিংবা আশা থাকে। এজন্যই তো একে অপরকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলে শুভ হোক নতুন বছর। নতুন বছরকে ঘিরে অনেক প্রত্যাশা থাকলেও সবকিছুই যে অর্জিত হবে এমন কোন কথা নেই। তারপরও মানুষ বিশ্বাস ও আশা করতে চায় যে, নতুন বছর হোক মঙ্গলময়ী একটি বছর। স্বাভাবিকভাবে বলা যায়, এটি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির মত একটি ব্যাপার। যে বছরটি চলে গেল সে বছরটি ছিল কেমন? বাংলাদেশ থেকে শুরু করে সারা বিশ্বের জন্য কি দিয়ে গেল বিদায়ী বছর ২০১৬ এবং কি নতুন বার্তা নিয়ে এলো নতুন বছর ২০১৭? এক বছর শেষ করে নতুন আরেক বছরে পদার্পন করার সময় এ রকম কিছু প্রশ্ন উঠে আসে বারবার।
সদ্য সমাপ্ত হওয়া ২০১৬ সালটি বাংলাদেশের জন্য প্রবৃদ্ধির একটি বছর ছিল বটে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের ঘরে এসেছে এই ২০১৬ সালে যা বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় একটি প্রাপ্তি ছিল। বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত বাংলাদেশ সফরে এসে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রশংসা করে। তবে প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি ছিল হতাশাজনক। ঋণ খেলাপির পরিমাণও বেড়ে যায় এ বছরে। তবে এত কিছুর পরেও দেশের প্রবৃদ্ধি অর্জন থেমে থাকেনি। অন্যদিকে, বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরটি বেশ উল্লেখযোগ্য ঘটনা। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের বিষয়টি এখানে বিশেষ গুরুত্ব পায়। এ ছাড়াও বন্ধ থাকা মালয়েশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাত তাদের দরজা উন্মুক্ত করার ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ থেকে নতুন করে জনশক্তি আমদানি করার। তবে বছরের সবচেয়ে বেশি আলোচিত ঘটনাটি হচ্ছে জঙ্গিবাদ। ২০১৬ সালে জঙ্গিবাদের চরম বহি:প্রকাশ ঘটে। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারির হামলাটি আজও মানুষ ভুলতে পারেনি। সারা বাংলাদেশকে স্তদ্ধ করে দেয় ঘটনাটি। এ ঘটনাটির মাত্র কয়েকদিন পরেই শোলকিয়ায় ঈদের জামাতে হামলার ঘটনাটি ঘটে। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ সর্তক ছিল বিধায় ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। ঈদের জামাতে যাবার আগেই জঙ্গিদের দমন করে ফেলে। এরপরই সরকার নড়েচড়ে বসে জঙ্গিবাদ দমনে। শুরু হয় একের পর এক জঙ্গি দমন। ২০১৬ সালের প্রায় অর্ধেক সময় জুড়ে ছিল আতঙ্কিত ও আলোচিত জঙ্গিবাদের সব ঘটনা। এখনো জঙ্গিবাদ নিয়ে সবার মাঝেই রয়েছে অল্প-বিস্তর আতঙ্ক। আরো একটি বাংলাদেশের জন্য বিশেষ উদ্বেগের ব্যাপার ছিল এই ২০১৬ সালে। আর তা হচ্ছে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বেশ কয়েকটি ঘটনা। তার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ও অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাটি থাকে নাসিরনগরের হামলা। নাসিরনগরের মন্দির ভাঙচুরের ঘটনাটি দেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনার উপর একটি বড় আঘাত বলা যায়। এ দিকে গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের সাথে সংঘর্ষের ঘটনাটিও থাকে বেশ আলোচিত। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিস্থিতি এক নতুন উত্তেজনাকর অবস্থায় বিরাজ করে। অন্যদিকে, ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগের ২০তম কাউন্সিল সম্মেলনটি ছিল দেশের রাজনীতির একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আওয়ামী লীগের এ সম্মেলনে ওবায়েদুল কাদের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হয়।
২০১৬ সালে বর্হিবিশ্বেও ঘটে যায় বেশ কয়েকটি বিস্ময়কর ও অনাকাঙ্খিত ঘটনা। ব্রেক্সিট ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা দুটি ছিল ২০১৬ সালের সবচেয়ে আলোচিত। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের আলাদা হবার ব্যাপারটি সবাইকে বিস্মিত করে। গণভোটে ৫৩ শতাংশ ব্রিটিশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে আলাদা হবার পক্ষে রায় দেয়ার পর পরই ব্রেক্সিটের জয় হয়। ব্রেক্সিটের কারণে সারা বিশ্বেই শেয়ার বাজারে ব্যাপক দরপতন হয়। এছাড়াও ইউরোপীয় ইউনিয়নে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়। ব্রিটেনে অনেক সংখ্যালঘু হয়রানির ঘটনাও ঘটে ব্রেক্সিটের পর পর। ইউরোপে দেখা দেয় এক নতুন সংকট। উগ্র জাতীয়তাবাদ ও রক্ষণশীলতার এক অভূত বিজয় হিসেবে বিবেচনা করা হয় এ ব্রেক্সিটকে। এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ী হবার ঘটনাটি থাকে আরো বেশি বিস্ময়কর। গণমাধ্যমের প্রায় সব জরিপে হিলারি ক্লিনটন এগিয়ে থাকলেও শেষ পর্যন্ত ডোনাল্ড ট্রাম্পই ৪৫তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প ছিলেন বরাবরই বিতর্কিত। বিভিন্ন উসকানিমূলক ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দিয়ে বহুবার সমালোচিত হয়েছেন। কিন্তু এরপরও তিনি জয়ী হলেন যা ছিল রীতিমত বিস্ময়কর একটি ব্যাপার। এগুলো ছাড়াও বিশ্বেও অন্যান্য দেশেও অনেক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে। তবে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতির তেমন কোন উন্নতি ঘটেনি। আরো একটি বিস্ময়কর ঘটনাটি ঘটে বিশ্বখ্যাত সংগীত শিল্পী বব ডিলানের সাহিত্যে নোবেল পাওয়ার ঘটনাটি। একে সংগীতের সাথে সাহিত্যের গভীর সম্পর্কের নির্দশনও বলা যায়। আর ২০১৬ সালের শেষ দিকে তুরস্কে নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূতকে হত্যার ঘটনাটি থাকে বেশ আলোচিত ও অনাকাক্সিক্ষত। আবার, পূর্ব জেরুজালেমে ফিলিস্তিনের ভূখ-ে ইসরায়েলের বসতি নির্মাণের বিপক্ষে জাতিসংঘে প্রস্তাব পাস হবার ঘটনাটিও ছিল বেশ উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এর আগেও এ রকম প্রস্তাব পাস হতে গেলে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দিলেও এবার তারা ভোট দান থেকে বিরত ছিল। ফলে প্রস্তাবটি পাস হতে আর বাধার সম্মুখীন হয়নি। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যে দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ট সম্পর্কে টানাপোড়ন শুরু হয়। এদিকে ২০১৬ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাস্মীর সীমান্ত নিয়ে যে বিরোধ শুরু হয় তা সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তোলে। এমনকি সার্ক শীর্ষ সম্মেলন পর্যন্ত স্থগিত হয়ে যায়। পাক-ভারত বিরোধের রেশ ধরে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর পারস্পারিক সম্পর্কেও দেখা দেয় এক নতুন সংকট। সবমিলিয়ে ২০১৬ সালটি বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য তেমন ইতিবাচক ছিল না।
কয়েকজন খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে ২০১৬ সালে। এর মধ্যে কিংবদন্তি মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর মৃত্যুটি ছিল বেশ দু:খজনক ঘটনা। এছাড়াও বিশ্বখ্যাত স্টার ওয়ার্সের অভিনেত্রী ক্যারি ফিশারের মৃত্যুর ঘটনাটি ছিল আরেকটি দু:খজনক ঘটনা। অন্যদিকে, বিংশ শতাব্দীর কিউবার কমিউনিস্ট বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর মৃত্যুও হয়েছে এ বছরে। তবে ফিদেল কাস্ত্রোর মৃত্যুর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কিউবার সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টি ছিল বিশ্ব রাজনীতির একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
সবশেষে, ২০১৬ সাল গেল চলে। কেমন হতে পারে ২০১৭ সাল? এ বিষয়ে তেমন নিশ্চিত করে কিছু না বলা গেলেও সম্ভাব্য অনেক কিছু বলা যেতে পারে। এ বছরে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবার একটি সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। দেশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিতে হলে যেসব নতুন অর্থনৈতিক পথ উন্মোচিত হবে সেসবকে কাজে লাগাতে হবে। তবে জঙ্গিবাদের বিষয়টি নিয়ে বিশেষ সজাগ থাকতে হবে। জঙ্গিবাদ এখনো এ দেশ থেকে নির্মুল হয়ে যায়নি। এ দিকে খুব শীঘ্রই বসতে যাচ্ছে পদ্মা সেতুর পিলার। বলা যায়, পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ এ বছরে বেশ খানিকটা এগিয়ে যেতে পারে। দেশের রাজনীতিতে আংশিক কিছু পরিবর্তন আসতে পারে বলে আশা করা যায়। কারণ, ইতিমধ্যে রাষ্ট্রপতির সাথে বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনা হয়েছে। এখন দেখার বিষয় নতুন এ বছরে রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচীর ধরণ কি থাকে। তবে যত যাই হোক সহিংসতা কোনদিনই কোনকিছুর সমাধান করতে পারে না Ñ এ ধারনাটি দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলগুলোর থাকা উচিত। এমন কিছু করা উচিত হবে না যা দেশের প্রবৃদ্ধিকে ব্যাহত করে। আর বিশ্ব নেতৃত্বে আসবে নতুন পরিবর্তন। কয়েকদিন পরেই ডোনাল্ড ট্রাম্প শপথ নিতে যাচ্ছেন। এরপরই বিশ্ব নেতৃত্বে আসবে নতুন ধাঁচ। সামগ্রিক বিবেচনায় নতুন এ বছর হতে পারে এক দিক দিয়ে আর্শীবাদ আবার অন্যদিক দিয়ে হতে পারে তা অভিশাপ। কিন্তু যাই হোক না কেন, অনেক আশা নিয়ে প্রতিটি নতুন বছর শুরু হয়। নতুনকে বরণ করে নেয়ার স্বাভাবিক প্রয়াস কাজ করারও প্রয়োজন রয়েছে। তাই, নতুন বছরের শুভেচ্ছা রইলো সবার প্রতি। শুভ হোক নতুন বছর ২০১৭।
© ২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | কর্পোরেট সংবাদ সম্পাদক - মোঃ মিজানুর রহমান । উপদেষ্টা সম্পাদক- জেসমিন আক্তার, এফসিএস ই-মেইলঃ corporatesangbad@gmail.com । ফোনঃ ০২২২-৩৩৫৪১২৫ । মোবাইলঃ ০১৭১১০৭৬৮১৫ অফিসঃ ৫৫/বি, নোয়াখালী টাওয়ার, ১১ তলা, সুইট ১১-এফ, পুরানা পল্টন, ঢাকা ১০০০ |
স্বাগত ২০১৭; কাঙ্খিত ও অনাকাঙ্খিত ঘটনাবহুল বছর ছিল ২০১৬ https://corporatesangbad.com/10522/ |